হতাশ করেছেন সু চি!

0

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমার। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৬২ সালে মিয়ানমারের শাসনকর্তৃত্ব সামরিক জান্তার হাতে চলে যায়। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে প্রথম নির্বাচন দিলে ওই নির্বাচনে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) জয়ী হলেও নির্বাচনী আইনের মাধ্যমে তা বাতিল করা হয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সামরিক শাসনের ইতি ঘটিয়ে ২০১৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা চালু হয় দেশটিতে।

বিশ্ববাসীর সামনে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে মিয়ানমার নাম লিখালেও আদতে দেশটির ঘাড়ে এখনো সামরিক বাহিনী চেপে বসে আছে। যারা দেশটিতে তাতমাদাও নামে পরিচিত। ২০০৮ সালে প্রণীত সংবিধান অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনে প্রস্তাব পার্লামেন্টে পাস করতে হলে ৭৫ শতাংশের বেশি সমর্থন প্রয়োজন। কিন্তু দেশটির পার্লামেন্টে এক-চতুর্থাংশ আসন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। এ ছাড়াও জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিষদের ১১টি আসনের মধ্যে ছয়টি আসনেও রয়েছেন সেনাবাহিনী মনোনীত ব্যক্তিরা।

নির্বাচনের আগে সু চির দল সেনাবাহিনীর ক্ষমতা কমানোর লক্ষে সংবিধান সংশোধন করবে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সংবিধানে থাকা সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা কমাতে না পারলে দেশটির গণতন্ত্র তাতমাদাওয়ের হাতে বন্দী থাকবে। সংবিধান সংশোধন করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হয় সু চির।

এনএলডি পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা হ্রাসের প্রস্তাব উত্থাপন করলে সাংবিধানিক সংস্কার সম্পর্কিত বিতর্কে অংশ নেন আইনপ্রণেতারা। বিতর্কে এনএলডি, সেনাবাহিনী সমর্থিত রাজনৈতিক দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (ইউএসডিপি), সেনা নিযুক্ত আইনপ্রণেতা ও জাতিগত দলগুলোর সদস্যরা অংশ নিয়েছিলেন। এ সময় এনএলডির প্রস্তাবের বিরোধিতা করে তা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে ইউএসডিপি। আর সামরিক বাহিনী হুঁশিয়ার করে বলেছে, তাতমাদাওয়ের শক্তি দুর্বল করা হলে অনাকাক্সিক্ষত পরিণতি হবে। এ ধরনের হুমকি দেশটির ভঙ্গুর গণতন্ত্রের উত্তরণকে প্রভাবিত করতে পারে। সামরিক বাহিনীর তীব্র বিরোধিতার মুখে এনএলডির পরবর্তী সংশোধনী প্রস্তাবগুলো পার্লামেন্টে পাস করা যায়নি।

যদিও ক্ষমতা গ্রহণের প্রায় তিন বছর পর প্রথমবারের মতো সু চির দলের পক্ষ থেকে সংবিধান সংশোধনের আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ নেয়া হয়। সে সময় এ সংক্রান্ত প্রস্তাব আলোচনার জন্য গৃহীত হবে কি-না, এ বিষয়ে অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে অনির্বাচিত ২৫ শতাংশ সেনা এমপি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। সেনাবাহিনী ভোটাভুটি বর্জন করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে প্রস্তাবটি পার্লামেন্টে আলোচনার জন্য গৃহীত হয়।
সেনানিযুক্ত আইনপ্রণেতাদের দাবী, এর ফলে নাগরিক-সামরিক সম্পক খারাপের দিকে যাবে এবং দেশটির জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক উত্তরণ ব্যাহত হবে। ১৯৫৮ এবং ১৯৬২ সালে সঙ্কটের পর সেনাবাহিনীর সংসদীয় উপস্থিতি সংরক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ দেশের জাতীয় সার্বভৌমত্ব, আইনের শাসন ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল। সশস্ত্র দ্বন্দ্বের অবসান ঘটার আগে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার আগে সামরিক আইনপ্রণেতাদের সংখ্যা হ্রাস করা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করবে। মিয়ানমারের সংবিধানে বলা রয়েছে, প্রতিরক্ষা পরিষেবা রাষ্ট্রের জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকায় অংশ নিতে সক্ষম।

সেনাবাহিনীর সাথে সু চির দ্বন্দ্বের মধ্যেই সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক ক্ষমতা খর্ব করার জন্য পার্লামেন্টে ভোটাভুটি হয়। তাতে হেরে যায় সু চির দল এনএলডি। প্রস্তাবটি প্রয়োজনীয় ৭৫ শতাংশ এমপির সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়। ফলে জরুরি অবস্থাকালীন সময়ে সামরিক বাহিনীর প্রধানের যে বিশেষ ক্ষমতা সংবিধানে দেয়া ছিল, সেটা এখনো বহাল থাকল। সামরিক বাহিনীর তৈরি ২০০৮ সালের এই সংবিধানে জরুরি অবস্থাকালীন সময়ে সামরিক বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফকে সার্বভৌম ক্ষমতা দেয়া আছে। এমনকি এ সময়ে তিনি আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগেও ক্ষমতার চর্চা করতে পারবেন। এ ছাড়া বর্তমান সংবিধানের নাগরিকত্বের ধারা অনুযায়ী সু চি দেশটির প্রেসিডেন্টও হতে পারবেন না।

গত ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতা চলায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। হত্যা, সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণ, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ফলে জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। এর বিপরীতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেননি সু চি। বরং গণহত্যার কথা অস্বীকার করে সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের পক্ষে সাফাই গেয়ে আসছেন তিনি। সর্বশেষ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গায়িম্বার করা মামলায় মিয়ানমারকে এসব বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বলেছে। কিন্তু এসবের কিছুতেই পাত্তা দিচ্ছেন না সু চি। সেনাশাসিত মিয়ানমারে জাতিগত বিভেদ কমিয়ে স্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে গণতন্ত্রীপন্থী এই নেত্রীর ভূমিকা সত্যিই হতাশাজনক।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com