করোনা ভাইরাস : শেয়ারবাজারে ‘রক্তগঙ্গা’ আর তেলের মূল্যে অস্থিরতা
করোনা ভাইরাস সঙ্কটকে ঘিরে বিশ্বজুড়ে শেয়ারবাজার আর তেলের বাজারে সোমবার যেরকম অস্থিরতা দেখা গেছে, তাকে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য ‘অশনি সঙ্কেত’ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে ইউরোপ, এশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া- প্রতিটি অঞ্চলের শেয়ার বাজারে বিরাট ধস দেখা গেছে সোমবার। অন্যদিকে তেলের উৎপাদন আরো বাড়াতে সৌদি আরবের এক তরফা সিদ্ধান্তের ফলে তেলের দাম পড়ে গেছে প্রায় বিশ ভাগ।
বিশ্ব পুঁজিবাজারে সোমবার দিনভর এই অবস্থার পর দিনটিকে ‘ব্ল্যাক মানডে’ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াল স্ট্রিটের শেয়ার বাজার খোলার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে দাম পড়ে যায় প্রায় সাত শতাংশ। এই বিরাট ধসের পর স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সেখানে শেয়ারবাজারে লেন-দেন বন্ধ হয়ে যায়।
এর আগে এশিয়া ও ইউরোপের শেয়ার বাজারেও দেখা গেছে একই পরিস্থিতি। কেউ কেউ শেয়ারবাজারে যা ঘটছে তাকে ‘রক্তগঙ্গা’ বয়ে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
২০০৯ সালে বিশ্বজুড়ে যে আর্থিক সংকট দেখা গিয়েছিল, তারপর এরকম বিপর্যয় আর শেয়ারবাজারে দেখা যায়নি।
কী ঘটছে শেয়ার বাজারে
অস্ট্রেলিয়া থেকে শুরু করে এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার সব বড় বড় স্টক এক্সচেঞ্জে সারাদিন ধরে একের পর এক ধস নেমেছে।
সোমবার লন্ডনের শেয়ার বাজারে ফুটসি ওয়ান হান্ড্রেড সূচক কমে গিয়েছিল ৮ দশমিক চার শতাংশ। এই সূচকের ইতিহাসে এটি চতুর্থ সর্বোচ্চ পতন। এর আগে ১৯৮৭ সালে দুবার আর ২০০৮ সালে একবার এত বিরাট দরপতনের ঘটনা ঘটেছে।
ইউরোপের পর যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজারে যখন লেন-দেন শুরু হয়, সেখানেও দেখা গেল একই চিত্র।
যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি বড় সূচকে বিরাট ধস নামে।
তেলের বাজারেও দেখা গেছে একই রকম অস্থিরতা। সোমবার একদিনেই তেলের দাম প্রায় তিরিশ শতাংশ কমে ৩১ ডলারে নামে। ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের পর একদিনের মধ্যে তেলের দাম আর কখনো এতটা কমেনি। পরে অবশ্য তেলের দাম কিছুটা বেড়েছে।
কেন এই অস্থিরতা
বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের অর্থনৈতিক সংবাদদাতা অ্যান্ড্রু ওয়াকার বলছেন, এই অস্থিরতার পেছনে আছে করোনাভাইরাস।
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের বিস্তৃতি যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে অর্থনীতি আর ব্যবসা-বাণিজ্যে। তেলের চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। তেল রফতানিকারক দেশগুলো তেলের দাম স্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। ওপেক চাইছিল তেলের উৎপাদন কমিয়ে দাম ঠিক রাখতে। কিন্তু রাশিয়া, যারা ওপেকের সদস্য নয়, তারা রাজি হয়নি।
তখন হঠাৎ করে সৌদি আরব, যারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল উৎপাদক, নিজেরাই তেলের উৎপাদন অনেক বাড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের লক্ষ্য ছিল রাশিয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের তেল কোম্পানিগুলোকে সমস্যায় ফেলে দেয়া। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ায় তেলের উৎপাদন খরচ বেশি, অল্প দামে বেশিদিন তারা তেল বিক্রি করতে পারবে না।
এসবের সম্মিলিত ফল দাঁড়ায় শেয়ার বাজারে অস্থিরতা।
তেলের দাম কমলে সেটা হয়তো ভোক্তাদের জন্য সুখবর। যেসব এয়ারলাইন্স এখন যাত্রীর অভাবে বিরাট সংকটে পড়েছে, তাদের দুর্দশাও কিছুটা লাঘব করবে তেলের বাজারে এই ধস।
মন্দার পদধ্বনি?
করোনাভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার সূচনা করতে পারে বলে অনেকে আশংকা করছিলেন, শেয়ারবাজারে অস্থিরতাকে তারই আভাস বলে বর্ণনা করছেন তারা।
অস্ট্রেলিয়ায় একটি মন্দার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে।
চীনের অর্থনীতি আর ব্যবসা-বাণিজ্যে যে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটিয়েছে করোনাভাইরাস, তার পরিণাম কী হতে পারে, সেটার হিসেব-নিকেশ চলছে। এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তা মোটেই ভালো কিছুর ইঙ্গিত দেয় না।
ইউরোপের দেশগুলোতে করোনাভাইরাসের বিস্তার শুরু হয়েছে মাত্র। চীন যেরকম কঠোরভাবে এই সংকট দমন করেছে, ইউরোপ তা পারবে কীনা, তা নিয়ে সংশয় আছে।
সব মিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে ২০২০ সাল আরেকটি মন্দার সূচনা করতে পারে, এমন আশংকাই প্রবল।