হতাশা থেকে দূরে থাকার উপায় ও দোয়া
জীবনে পাওয়া না পাওয়ার বেদনায় হতাশ হওয়া কিংবা মানসিক চাপ অনুভব করা নতুন কিছু নয়। বিপদ-আপদ, চাপ কিংবা না পাওয়ার বেদনা যত বেশিই হোক না কেন কোনো অবস্থায়ই হতাশ হওয়া ঈমানদারের কাজ নয়। বরং সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর ওপর আস্থা রাখাই সুস্থ থাকার উপায় এবং বুদ্ধিমানের কাজ।
এ কথা মনে রাখা উচিত, যে কোনো সময় যে কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে মানুষ। কুরআনুল কারিমে এমন ইঙ্গিত এসেছে অনেকবার। তখনই আল্লাহর সেই বাণীর ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ স্মরণ করাই সবার কাজ।
বিপদ-আপদ, হতাশা, রোগ-শোক সবই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য পরীক্ষা। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করবো সামান্য ভয় ও ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফসলের কিছুটা ক্ষতি দিয়ে; আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও- যাদের ওপর কোনো বিপদ এলে বলে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’- নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর আর অবশ্যই আমরা তাঁর কাছেই ফিরে যাব।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৫৫-১৫৬)
সুতরাং যে কোনো পরিস্থিতিতে হতাশা কিংবা মানসিক চাপ সামলাতে কুরআন-সুন্নাহর আমল করা। আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা আবশ্যক। হতাশা কিংবা মানসিক চাপ বেড়ে গেলে যে আমলগুলো করা জরুরি তাহলো-
> কুরআন তেলাওয়াত করা
হতাশা ও মানসিক চাপ কমাতে কুরআন তেলাওয়াতের বিকল্প নেই। মহান আল্লাহর মধুর বাণী কুরআন তেলাওয়াত মানুষের মনকে প্রফুল্ল করে তোলে। কেননা কুরআন তেলাওয়াত মানুষের অন্তরের প্রফুল্লতার অন্যতম উৎস। কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমেই মানুষ মনের প্রফুল্লতা ও মানসিক প্রশান্তি পেয়ে থাকে। দুঃশ্চিন্তা ও হতাশা থেকে মুক্ত থাকে।
> দোয়া ও জিকির করা
হতাশা কাটাতে এবং মনে প্রশান্তি পেতে বেশি বেশি আল্লাহর জিকির ও দোয়া করা। কেননা দোয়া এবং জিকিরের মাধ্যমে মনে প্রশান্তি আসে বলে ঘোষণা করেছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা-
الَّذِينَ آمَنُواْ وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ اللّهِ أَلاَ بِذِكْرِ اللّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ
‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; ‘জেনে রাখ! আল্লাহর জিকির দ্বারা অন্তরে স্থিরতা ও শান্তি আসে।’ (সুরা রাদ : আয়াত ২৮)
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোনো দুঃখ-কষ্ট বা চিন্তা, অস্থিরতা তথা হতাশাগ্রস্ত হতেন তখন বলতেন-
يَا حَيُّ يَا قَيُّوْمُ بِرَحْمَتِكَ أَسْتَغِيْثُ
উচ্চারণ : ইয়া- হাইয়ু ইয়া- ক্বাইয়ূ-মু বিরাহমাতিকা আস্তাগিছ।
অর্থ : ‘হে চিরঞ্জীব! হে চিরস্থায়ী! আপনার রহমতের মাধ্যমে আপনার নিকটে সাহায্য চাই।’ (তিরমিজি, মুসতাদরেকে হাকেম, মিশকাত)
لَا اِلَهَ اِلَّا اَنْتَ سُبْحَانَكَ اِنِّى كَنْتُ مِنَ الظَّالِمِيْنَ
উচ্চারণ : ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জ্বলিমিন।’
অর্থ : হে আল্লাহ! তুমি ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই; আমি তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। নিঃসন্দেহে আমি জালিমদের অন্তর্ভুক্ত।’ (তিরমিজি)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চিন্তা ও পেরেশানির সময় এ বিশেষ দোয়াটি বেশি বেশি পড়তেন। তাহলো-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ، وَالْعَجْزِ وَ أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْبُخْلِ وَالْجُبْنِ، وَ أَعُوذُ بِكَ مِنَ ضَلَعِ الدَّيْنِ، وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযু বিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাযানি, ওয়া আউযু বিকা মিনাল বুখলি ওয়াল জুবনি, ওয়া আউযু বিকা মিন দ্বালা’য়িদ্দাইনি ওয়া গালাবাতির রিজাল।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)
অর্থ : হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থেকে আপনার আশ্রয় চাই, অপারগতা ও অলসতা থেকে আপনার আশ্রয় চাই, কৃপনতা ও ভীরুতা থেকে আপনার আশ্রয় চাই আর ঋণের ভার ও মানুষদের দমন-পীড়ন থেকেও আপনার আশ্রয় চাই।
> নামাজে মনোযোগী হওয়া
বিপদ-মুসিবত, পেরেশানির সময় নামাজের মাধ্যমেই প্রকৃত প্রশান্তি লাভ কর যায়। কেননা নামাজের মাধ্যমেই বান্দা মহান আল্লাহর সাহায্য লাভ করে থাকেন। তাই মানসিক প্রশান্তি পেতে নামাজে মনোযোগী হওয়া আবশ্যক। আল্লাহ তাআলা বলেন-
’তোমরা নামাজ ও ধৈর্যের মাধ্যমে আমার সাহায্য প্রার্থনা কর। অবশ্য তা যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু সে সমস্ত বিনয়ী লোকদের পক্ষেই তা সম্ভব।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ৪৫)
হাদিসে এসেছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোনো কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতেন তখন নামাজ আদায় করতেন।’ (আবু দাউদ)
সাহাবায়ে কেরামও এ আমলে অভ্যস্ত ছিলেন। তাঁরা অতি ছোট বিষয়ের জন্যও তারা নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। এমনকি জুতার ফিতা ছিড়ে গেলেও নামাজের মাধ্যমে সমাধা করতেন।
> হাসি-খুশি থাকার চেষ্টা করা
অস্থিরতা ও হতাশা কাটাতে হাসি-খুশি থাকার বিকল্প নেই। যে কাজ করলে মনে শান্তি পাওয়া যাবে; সে কাজে নিজেকে অভ্যস্ত করে তোলা; যদি তা হালাল হয়। তবে কোনোভাবেই হারাম কাজের সঙ্গে জড়িত হওয়া যাবে না। হতাশামুক্ত থাকতে চলাফেরা, উঠাবসাসহ যে কোনো বিনোদনের ক্ষেত্রে হালাল-হারাম মেনে চলা খুবই জরুরি।
> আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল করা
মানসিক হতাশা ও অশান্তি থেকে মুক্ত থাকতে মহান আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুলের বিকল্প নেই। কেননা তিনিই বলেছেন- ‘যে মহান আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল বা ভরসা করে, তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সুরা তালাক : আয়াত ৩)
আর যে ব্যক্তি দুনিয়ায় সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল করতে জানে তার কোনো চিন্তা নেই। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন- আমি সেরূপ, যেরূপ বান্দা আমার প্রতি ধারণা রাখে।’ (বুখারি)
> তাওবাহ-ইসতেগফার করা
তাওবাহ-ইসতেগফারে হতাশা ও মানসিক চাপ কমে। জীবিকার অভাব কমে। সন্তান-সন্তুতির অভাব কমে। গোনাহ মাফ হয়। এসব সমাধানের কথা বলেছেন মহান আল্লাহ তাআলা-
‘তারপর বলেছি- তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর অজস্র বৃষ্টিধারা ছেড়ে দেবেন। তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি বাড়িয়ে দেবেন, তোমাদের জন্যে উদ্যান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্যে নদীনালা প্রবাহিত করবেন।’ (সুরা নুহ : আয়াত ১০-১২)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিয়মিত ইসতেগফার করবে, আল্লাহ তাআলা তার সব সংকট দূর করে দেবেন। সমাধানের পথ বের করে দেবেন। তার সব দুঃশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন।’ (আবু দাউদ)
সুতরাং কোনো অবস্থাতেই হতাশা না হওয়া। মহান আল্লাহর ওপর অগাধ আস্থা এবং বিশ্বাস রাখা। মনে প্রশান্তি লাভে জিকির, দোয়া, তাওবাহ-ইসতেগফার, নামাজে মনোযোগী হওয়া।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হতাশার সময় উল্লেখিত আমলগুলো ও দোয়াগুলো যথাযথভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন। হতাশা থেকে হেফাজত করুন। আমিন।