নিত্যপণ্য এখন বিলাসী পণ্যে পরিণত, বিপাকে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ

0

অস্বাভাবিক হারে দাম বাড়ার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এখন বিলাসবহুল পণ্যে পরিণত হয়েছে। এতে করে দেশের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে। গরিব ও মধ্যবিত্তরা যেসব খাদ্যপণ্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন, মুনাফাখোররা সেগুলোতেই সবচেয়ে বেশি লাভ করছেন। বাজার নজরদারি ব্যবস্থায় দুর্বলতার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা সরকারের জন্য বড় ধরনের ব্যর্থতা। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এই অভিমত তুলে ধরেছেন।

রবিবার সিপিডি আয়োজিত ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০২৩-২৪ : তৃতীয় অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

এ সময় তিনি বলেন, এ দেশে ধনীদের চালের চেয়ে গরিবের চালের দাম বেশি বেড়েছে। গত সাড়ে পাঁচ বছরে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে যে মোটা চালের দাম ছিল কেজিপ্রতি ৪০ টাকা, গত মে মাসে তা বিক্রি হয়েছে ৫২ টাকায়। একই সময়ে অপেক্ষাকৃত বেশি মূল্যের মিনিকেট ও পাইজাম চালের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ১৭ ও ১৮ শতাংশ। অর্থাৎ মুনাফাখোররা বেশি লাভ যেখানে করছেন, যে পণ্য গরিব ও মধ্যবিত্তরা ব্যবহার করেন এবং বাজারে বেশি বিক্রি হয়। তিনি বলেন, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশে চালের দাম বেশি। গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘মূল্যস্ফীতিতে আমরা ৯ ও ১০ শতাংশে অবস্থান করছি। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার চেয়েও বেশি।’

তিনি বলেন, ২০১৯ সালের তুলনায় দেশে মসুর ডাল ৯৫, আটা ৪০-৫৪, ময়দা ৬০, খোলা সয়াবিন ৮৪, বোতলজাত সয়াবিন ৫৬ ও পামঅয়েলের দাম ১০৬ শতাংশ বেড়েছে। গরুর মাংসের দামও বেশি। ব্রয়লার মুরগি ৬০, চিনি ১৫২, গুঁড়োদুধ ৪৬-৮০, পেঁয়াজ ১৬৪, রসুন ৩১০ ও শুকনা মরিচ ১০৫ শতাংশ বেড়েছে। যা আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় অনেক বেশি।

সিপিডির এই গবেষণা পরিচালক বলেন, বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের কারণে দেশের অর্থনীতি বর্তমানে বেশ চাপে আছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পরিবর্তে দুর্বল ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার দিকে নজর দিতে হবে।

তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা সরকারের জন্য বড় ধরনের ব্যর্থতা। ২০১৯ সাল থেকে খাদ্যমূল্য বিবেচনা করলে অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি। ধনী ও গরিবের বৈষম্য বেড়েছে। গরিবের আয় বাড়েনি। জিডিপিতে জাতীয় আয় বাড়ছে, কিন্তু কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখতে পারছে না।

নিম্নআয়ের দেশ হয়েও বাংলাদেশ বিলাসী দেশে পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘আমরা আয় করি কম, কিন্তু খাবারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করতে হয়। যার ভুক্তভোগী গরিব ও সাধারণ মানুষ। সরকারের প্রচেষ্টা রয়েছে। অনেক সময় নিত্যপণ্যের শুল্ক ট্যারিফ কমিয়ে দেয়, তার সুফল তোলেন এক ধরনের ব্যবসায়ীরা।’

অর্থনীতি ধারাবাহিকভাবে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনাভাইরাস মহামারীতে অর্থনীতিতে যে সংকট তৈরি হয়েছিল পরের বছর কিছুটা কমে এলেও সঙ্গে যোগ হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নীতির দুর্বলতা, সুশাসনের অভাব ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের ব্যর্থতা। এগুলো ধারাবাহিকভাবে চলেছে।

এই গবেষক বলেন, এসব চ্যালেঞ্জ চলতি বছরেই নতুন না, আগের বছরেও ছিল। এগুলো মোকাবিলা করতেই সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফের) সঙ্গে অর্থনৈতিক সংস্কারে গেছে, ঋণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কিন্তু এই সংস্কার কর্মসূচি বড় ধরনের কোনো ফল দেবে, এখন পর্যন্ত তা চোখে পড়েনি।

সরকারের সামনে দুটি পথ রয়েছে, এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, উচ্চ প্রবৃদ্ধি আর সামগ্রিক স্থিতিশীলতা। উচ্চ প্রবৃদ্ধির চেয়ে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখা উচিত। সরকারের সূচকগুলো ধরার ক্ষেত্রে এক ধরনের গতানুগতিক পথে রয়েছে। নিম্ন প্রবৃদ্ধি নিয়ে সামষ্টিক স্থিতিশীলতা অর্জন করতে না পারলে দুদিক থেকে ক্ষতি হবে।

ধনী ও গরিবের বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বর্তমানে মাথাপিছু অভ্যন্তরীণ আয় ২ হাজার ৬৭৫ মার্কিন ডলার, আর মাথাপিছু জাতীয় আয় ২ হাজার ৭৮৪ ডলার। মাথাপিছু গড় আয় যতটুকু হয়েছে তা মূলত যারা উচ্চ আয় করেন তাদের কারণে। গরিব মানুষদের কথা বিবেচনা করলে তাদের আয় কমে গেছে।

বেসরকারি বিনিয়োগ দেখা যাচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারের অতিরিক্ত ঋণ নেওয়া একটি বড় কারণ। বিষয়টি সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সরকারের ৭ দশমিক ৫ শতাংশ বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বলে মনে করেন গোলাম মোয়াজ্জেম।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। কিন্তু জানুয়ারিতে তা সংশোধন করে ধরা হয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ। আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তা আরও কম প্রাক্কলন করেছে। বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক দূরে রয়েছে সরকার। জিডিপি বৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থানের ধারাটি বাড়ছে না, বরং কমছে। জিডিপিতে জাতীয় আয় বাড়ছে, কিন্তু কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখতে পারছে না বা কম সহায়তা করছে। যতটুকু কর্মসংস্থান হচ্ছে তা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে বাড়ছে, যা আসলে ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ওই কর্মসংস্থানে মজুরি ও নিরাপত্তার হুমকি রয়েছে।

রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রসঙ্গে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘রাজস্ব আদায়ের ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি, যা গত বছরের জুলাই-জানুয়ারি হিসেবে ভালো অবস্থানে রয়েছে। গত বছর নেতিবাচক ছিল। সেখান থেকে ইতিবাচক ধারায় ফিরে এসেছি, সেটা ভালো দিক। যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হয়, তাহলে ৬৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে, যা অর্জন করা অসম্ভব। অন্যদিকে এনবিআরের ক্ষেত্রে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ১৬ শতাংশ। আয়ের বড় অংশ হচ্ছে ভ্যাট ও শুল্ক থেকে। অভ্যন্তরীণ মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বেড়েছে। আমদানির ক্ষেত্রে শক্ত অবস্থানের কারণে আমদানি শুল্ক কমেছে। এত কিছুর পর আইএমএফের নির্দেশনা অনুসরণ করে সরকার যে রাজস্ব বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিয়েছে, তা বাস্তবায়ন হবে না বলে মনে করছি।’

তিনি বলেন, সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিচ্ছে। সরকার বর্ধিত আকারে ঋণ নেওয়ার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ছে। এছাড়াও সরকার যে বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভর করছে সেই ঋণের যৌক্তিকতা আছে কি না সেটা দেখার বিষয়।

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘আমরা মনে করি সরকারের আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কয়েকটি জায়গায় নজর দেওয়া দরকার, সরকারের রাজস্ব স্পেস বাড়ানো দরকার। সেটা করতে হলে সরকারকে আগে লিকেজ বন্ধ করতে হবে। কর ফাঁকি বা কর এড়িয়ে যাওয়া, এগুলোকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কর কাঠামোকে ডিজিটালাইজেশন করা অবৈধ লেনদেন বা অর্থ পাচারের মতো যে ঘটনা ঘটছে সেই জায়গাগুলোতে নজর দেওয়া প্রয়োজন।’

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com