ইসরায়েলি ভূখণ্ডে ইরানের সরাসরি হামলার ঘটনায় আসলে কারা জয়ী হলো?
সিরিয়ায় ইরানের কনস্যুলেটে হামলার ১২ দিন পর ইসরায়েলি ভূখণ্ড লক্ষ্য করে শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে তেহরান। এই হামলার মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার রফাদফা হয়ে গেছে বলে তেহরান ঘোষণা দিলেও পাল্টা হামলার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে তেলআবিব। কিন্তু ইসরায়েলি ভূখণ্ডে ইরানের সরাসরি প্রথম এমন হামলার ঘটনায় আসলে কারা জয়ী হলো, সেই প্রশ্ন এখন সামনে আসছে।
ইসরায়েলের ভূখণ্ডে ইরানের প্রথম হামলার বর্ণনা দিয়ে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলেছেন, ‘‘ইরানের পক্ষে ড্র হয়েছে।’’ ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, শনিবার রাতে তেহরান ইসরায়েলের দিকে ৩০০টিরও বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। ইরানি সেনাবাহিনী দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলার প্রতিক্রিয়া হিসাবে ইরান এই হামলা চালিয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছে। তেহরান বলেছে, এর মাধ্যমে তারা নিজেদের সব ধরনের উদ্দেশ্য হাসিল করেছে।’’
গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে যে বিমান হামলা হয়েছে সেটা ইসরায়েল চালিয়েছে বলে দাবি করে ইরান। এর কঠোর জবাব দেওয়া হবে বলে হুমকি দিয়েছিল তারা। ওই বিমান হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ডের সাত সদস্য এবং ছয় সিরীয় নাগরিক নিহত হন। তবে কনস্যুলেটে হামলা চালানোর অভিযোগ স্বীকার করেনি ইসরায়েল। তবে এর পেছনে ইসরায়েলের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
• কার লাভ কার ক্ষতি?
ইসরায়েলে হামলা সফল হয়েছে বলে দাবি করেছে ইরান। কিন্তু ইরানের গবেষক ও লন্ডন-ভিত্তিক সেন্টার ফর আরব-ইরানিয়ান স্টাডিজের পরিচালক আলী নুরি জাদেহের মতে, এই হামলার মাধ্যমে ইরান কোনও পয়েন্ট স্কোর করেনি।
তিনি বলেছেন, বরং এটি ইরানের শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ করেছে। কারণ তারা ইসরায়েলের ভূখণ্ডে কোনও লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারেনি। এটি ইরানের কিছু মানুষের মধ্যে উপহাসের জন্ম দিয়েছে।
জাদেহ বিশ্বাস করেন, ইরান যদি ইসরায়েলের সাথে তাদের কথিত ‘‘সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’’ অব্যাহত রাখতো, তাহলে এর মাধ্যমে তারা আরও অনেক কিছু অর্জন করতে পারতো। অন্যদিকে, তেল আবিব ইউনিভার্সিটির মোশে দায়ান সেন্টারের মিডল ইস্ট স্টাডিজের গবেষক ড. এরিক রুন্ডটস্কি বলেছেন, ইসরায়েল রাষ্ট্রীয় সতর্কতা বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে পরাজিত হয়েছে।
তিনি বলেন, এটি ইসরায়েলিদের মধ্যে উদ্বেগকে উস্কে দিয়েছে এবং অনেকেই এই ধরনের হামলার পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা করছেন। জাদেহ বলেন, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এখন নিজেদের আরও বেশি শক্তিশালী মনে করছেন।
শনিবারের আগ পর্যন্ত ইসরায়েল ব্যাপক সমালোচনার মুখে থাকলেও ইরানের এই হামলা যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে ইসরায়েলের শক্তিশালী সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছে। ইসরায়েলি গবেষক বলছেন, হামলা থেকে ইসরায়েলিদের কিছু লাভ হতে পারে। কিন্তু তারা সেটা অন্য উপায়ে হারিয়েছে।
তার ধারণা এই হামলার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিকে চিনতে ইসরায়েলের ব্যর্থতা সেইসাথে ইরানকে নিজেদের সীমানায় আঘাত করা থেকে বিরত রাখতে ইসরায়েলের ব্যর্থতার বিষয়টিকে স্পষ্ট করেছে।
• অন্য দেশের সাথে ফিরেছে ঘনিষ্ঠতা
ইসরায়েলি গবেষক এরিক রুন্ডটস্কিও মনে করেন, ইরানের হামলা ইসরায়েলের জন্য লাভজনক হয়েছে। তিনি বলেন, এটি রাজনৈতিকভাবে একটি ‘‘টার্নিং পয়েন্ট’’ হিসাবে কাজ করতে পারে। কারণ গত কয়েক মাসের মধ্যে এই প্রথম ইসরায়েল পশ্চিমা সমর্থন উপভোগ করছে।
তিনি বলেন, সম্পর্কের ক্ষেত্রে এতদিন নজিরবিহীন উত্তেজনার পর ইসরায়েল এই দেশগুলোর সাথে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে ফিরে আসতে পারে। বিপরীতে ইরানি গবেষক আলী নুরি জাদেহ বিশ্বাস করেন, তেহরান রাজনৈতিকভাবে সেইসাথে অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক দু’ভাবেই হেরেছে।
ইসরায়েলি এই গবেষক বলেন, ইরান প্রতিবেশী দেশগুলোর সমর্থন হারিয়েছে এবং তাদের পক্ষে কোনও দেশের সমর্থন ছিল না। কিছু মহল থেকে ইরানকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সরাসরি যুদ্ধে টেনে আনার চেষ্টা চলছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
দুই গবেষক উভয় দেশের অভ্যন্তরীণ চাপ স্বীকার করেছেন। রুন্ডটস্কি বলেছেন, ইসরায়েলের অভ্যন্তরে বড় উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, যুদ্ধের সাথে সাথে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যার কারণে ক্ষোভ বেড়েছে। সেইসাথে গাজায় আটক জিম্মিদের মুক্ত করার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কোনও অগ্রগতি না হওয়ায় এই ক্ষোভ যেন আরও বেড়েছে।
জাদেহর বিশ্বাস, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি কেবল পথেঘাটে নয়, বরং তার শাসনের মধ্যে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকেও তীব্র চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন। ‘‘ইরানের আল-কুদস ব্রিগেডের সাত নেতা ইসরায়েলের হামলায় নিহত হওয়ার পর বিপ্লবী গার্ডের চাপ রয়েছে। কারণ গার্ডরা প্রতিশোধের দাবি করছে।’’
• অগ্নিবার্তা
লেবাননের অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল হিশাম জাবের সামরিক ও কৌশলগত বিশেষজ্ঞ এবং বৈরুতে মিডল ইস্ট সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। বিবিসি নিউজ অ্যারাবিককে তিনি বলেছেন, ‘‘এই হামলার ঘটনায় সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল এটি আশ্চর্যজনক ছিল না।
তিনি বলেন, এর কারণ দুই সপ্তাহের ‘‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’’ পরিস্থিতিকে বিমান হামলার দিকে পরিচালিত করেছে। আর এই পুরো সময়জুড়ে ইসরায়েল ‘‘আতঙ্কে’’ ছিল।
‘‘হামলার কারণে অনেক নাগরিক সেবা ব্যাহত হয়েছে এবং অনেক ইসরায়েলি নাগরিক তাদের বাড়িঘর ছেড়ে চলে গেছেন। ফলে এতে মানসিক এবং বস্তুগত ক্ষতি হয়েছে।’’ জাবের ইরানের এই অভিযানকে ‘‘অগ্নি বার্তা’’ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন।
কেননা এর মাধ্যমে ইসরায়েলি ভূখণ্ডের আরও ভেতরে পৌঁছানোর ক্ষমতা যেমন প্রকাশ পেয়েছে তেমনি ইসরায়েলি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রস্তুতি কেমন সেটা পরীক্ষা করার ক্ষমতাও প্রদর্শন হয়েছে। তিনি বলেন, এই হামলা ইরানকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিকভাবে হারানো মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করেছে। কারণ ইরান এতদিন ‘‘কৌশলগত ধৈর্যের নীতি’’ অনুসরণ করেছিল এবং এর ফলে তারা সামরিক ও কৌশলগতভাবেও লাভবান হয়েছে।
লেবাননের এই সামরিক বিশেষজ্ঞের ধারণা, ইরান ইসরায়েলের বিমান প্রতিরক্ষাকে বিভ্রান্ত করার জন্য বিপুল পরিমাণ ড্রোন নিক্ষেপ করেছে। তিনি বলেন, ইসরায়েলের আয়রন ডোম একা সব ক্ষেপণাস্ত্র আটকাতে পারেনি। এ জন্য মধ্যপ্রাচ্যের ঘাঁটিতে অবস্থানরত মার্কিন এবং ব্রিটিশ বাহিনীকে সহায়তা করতে হয়েছে।
‘‘ইসরায়েল যদি সামরিকভাবে এই হামলার জবাব দেওয়ার পথ বেছে নেয়, তাহলে তারা তাদের ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে ইরানের মূল ভূখণ্ডে পৌঁছাতে পারে। তবে তারা সেটা পারবে না। কারণ এখন ইরানের কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখানোর আশঙ্কা রয়েছে।’’
তিনি বলেন, ইসরায়েলি বিমানগুলো ইরানে নির্ভুলভাবে বোমা ফেলতে পারে। তবে তাদের আরব দেশগুলোর ওপর দিয়ে উড়তে হবে; যার ব্যাপারে ইরান সতর্ক করেছে বা এই অঞ্চলে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি থেকে ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করতে হবে। যদিও সেটার অনুমতি যুক্তরাষ্ট্র দেবে না।
• গতিপথ পরিবর্তন এবং আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধার
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ফাওয়াজ গের্জেস বলেন, ইরানের তুলনায় ইসরায়েল এই হামলা থেকে বেশি লাভবান হয়েছে। বিষয়টির ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ইরানের হামলায় ইসরায়েলের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি বা হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এখন পুরো পশ্চিমা বিশ্ব ইসরায়েলকে সমর্থন করছে।
তিনি বলেন, ইসরায়েলকে অস্ত্র, গোয়েন্দা সহায়তা এবং আর্থিক সহায়তার দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতি পশ্চিমা সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে। গের্জেস বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন আদায়ের জন্য জি-সেভেন দেশগুলোর একটি জরুরি শীর্ষ সম্মেলনের আহ্বান জানিয়েছেন।
গের্জেস বলেন, বাইডেন ইসরায়েলকে ভিক্টিম হিসাবে উপস্থাপন করছেন। গাজায় চলমান বিপর্যয়কর এবং জঘন্য ঘটনা থেকে সবার মনোযোগ সাময়িকভাবে সরিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে নেতানিয়াহু রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবেন।
গাজায় ভয়াবহ নৃশংসতার জন্য গত কয়েক মাস ধরে ইসরায়েল পশ্চিমা দেশগুলোর তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে। বর্তমানে ইরানের হামলার পর নেতানিয়াহু পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে তাদের সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করে লাভবান হবেন, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে।
• ইসরায়েলের কৌশলগত ক্ষতি
ইসরায়েলের ক্ষেত্রে একটি খারাপ দিকও দেখেছেন গের্জেস। তিনি বলেন, ইরান হামলা চালানোর ফলে ইসরায়েলের দুর্বলতা ফুটে উঠেছে; যা তাদের জন্য এক ধরনের কৌশলগত ক্ষতি।
তিনি বলেন, ইরান তার জনগণ, মিত্র এবং শত্রুদের কাছে ইসরায়েলকে মোকাবিলা করার ইচ্ছা সরাসরি প্রকাশ করে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে। গের্জেস বিশ্বাস করেন, ইরান এই হামলা চালানোর মাধ্যমে প্রমাণ করেছে যে, ইসরায়েল তার পশ্চিমা মিত্রদের ছাড়া একা নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং জর্ডান ইরানের অনেক ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করেছে।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের এই অধ্যাপক বলেন, সম্প্রতি ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েল একের পর এক হামলা চালিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছিল ইরান দুর্বল এবং তাদের মুখোমুখি লড়াইয়ের সাহস নেই। ইরানের হামলা সেই দৃষ্টিভঙ্গি গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
গের্জেসের মতে, এই অঞ্চলটি এখন তাণ্ডবের কেন্দ্রে রয়েছে। কেননা দুই দেশই তাদের অবস্থান আরও দৃঢ় করার শপথ নিয়েছে। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, অঞ্চলটি রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।’’