ভোটের আগে পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার ‘অপব্যবহার’ হচ্ছে?

0

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ভূপতিনগর নামে একটি এলাকায় কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ’র টিমের ওপর স্থানীয় বাসিন্দাদের হামলার অভিযোগ এবং ওই সংস্থার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই শ্লীলতাহানি ও হেনস্থার পাল্টা অভিযোগকে ঘিরে আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজ্যের রাজনীতি।

ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোকে ‘অপব্যবহারের’ অভিযোগ তুলে আবারও সরব হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা ব্যানার্জী। সোমবার এই ইস্যুতে নির্বাচন কমিশনেরও দ্বারস্থ হয়েছে তৃণমূল।

এরই মধ্যে পুরুলিয়ায় তৃণমূল প্রার্থী শান্তিরাম মাহাতোর হয়ে প্রচারসভা থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি তোপ দাগেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। সেখানে তিনি বলেন, এনআইএ, সিবিআই, বিজেপি ভাই-ভাই। ইডি আর ইনকাম ট্যাক্স বিজেপির টাকা তোলার বাক্স।

মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, ভোট সামনে এলেই কেন্দ্রীয় সরকারের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি), সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই), ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ)-র মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলাকে ‘অপব্যবহার’ করে থাকে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি।

পূর্ব মেদিনীপুরের নাড়ুয়াবিলা গ্রামে এনআইএ কর্মকর্তাদের পাঠানোর পদক্ষেপ তারই ‘প্রতিফলন’ বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।

অন্যদিকে, জাতীয় তদন্ত সংস্থা বা এনআইএ’র কর্মকর্তাদের ওপর আক্রমণের ঘটনা নিয়ে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। এই ঘটনায় তৃণমূলকে নিশানায় রেখে তিনি অভিযোগ করেছেন, পশ্চিমবঙ্গে তোলাবাজ, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের রক্ষা করতে কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোর ওপর হামলা চালাচ্ছে তৃণমূল।

প্রসঙ্গত, ২০২২ সালে ভূপতিনগরে একটি বিস্ফোরণ মামলার তদন্ত করছে এনআইএ। এই ঘটনায় অভিযুক্ত স্থানীয় দুই তৃণমূল নেতার খোঁজে গত শনিবার ওই এলাকায় যান তদন্তকারী কর্মকর্তারা।

এনআইএ’র অভিযোগ, ধৃতদের গাড়িতে তোলার পরেই তাদের গাড়িতে হামলা চালানো হয়। সেদিনই ভূপতিনগর থানায় হামলার লিখিত অভিযোগ দায়ের করে এনআইএ।

পরে শনিবার রাতে ভূপতিনগর থানায় এনআইএ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ দায়ের করে ধৃত এক তৃণমূল নেতার পরিবার।

ভূপতিনগরের ঘটনায় এনআইএ-কেই কাঠগড়ায় তুলেছেন মমতা ব্যানার্জী। একই সঙ্গে তোপ দাগেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ওপরেও।

ঘটনার দিনই তিনি বলেন, আমি যখন হেমতাবাদ থেকে বেরোচ্ছিলাম, সাংবাদিকরা আমাকে প্রশ্ন করেছেন, ভূপতিনগরে হামলা হয়েছে। হামলাটা কে করেছে? হামলা মেয়েরা করেনি, হামলা করেছে এনআইএ।

২০২২ সালে ভূপতিনগরের নাড়ুয়াবিলা গ্রামে বিস্ফোরণের ঘটনাকে বিশেষ আমল দিতে নারাজ মুখ্যমন্ত্রী। তার দাবি, এনআইএ-র ‘অতিসক্রিয়তার’ আসল কারণ হল ‘ভোটের ফলফল আঁচ করতে পেরেছে বিজেপি’।

একই সঙ্গে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন তদন্তের অভিযানের জন্য কেন কাকভোরে যেতে হয়েছিল এনআইএ টিমকে?

ভূপতিনগরের প্রসঙ্গ টেনে গত রোববার পুরুলিয়ার হুড়াতে একটি সভা থেকে মমতা বলেন, গাদ্দার জানে হারবে, তাই লোকের বাড়ি গিয়ে গিয়ে… কোথায় একটা চকোলেট বোমা ফেটেছিল ২০২২ সালে… আর মধ্যরাতে গিয়ে যদি নারীদের বাড়িতে অত্যাচার করে, গ্রামে ঢুকে অত্যাচার করে, নারীরা কী করবে? শাঁখা-পলা পরে বসে থাকবে? না মাথায় ওড়না দিয়ে বসে থাকবে? তারা তাদের ইজ্জত-সম্মান রক্ষা করবে না?

‘গাদ্দার’ বা বেইমান বলতে তিনি বুঝিয়েছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা, বিজেপির শুভেন্দু অধিকারীকে, যিনি বছর তিনেক আগে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের আগে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন।

‘গোটা দেশকে জেল বানান’
দিনকয়েক আগে উত্তরবঙ্গে একটি জনসভায় দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এমন নেতাদের নিশানায় রেখে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তৃণমূল, বাম ও কংগ্রেস একে অপরকে বাঁচাতে ইন্ডিয়া জোট তৈরি করেছে। গত ৪ জুন ভোটের ফল প্রকাশের পর বিজেপি আরও কড়া হাতে দুর্নীতি দমন করবে।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী এর জবাব দিয়েছেন সোমবার। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং ঝাড়খণ্ডের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকে গ্রেফতারের ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে বাঁকুড়ার জনসভায় তিনি বলেছেন, (প্রধানমন্ত্রী)‌ বলছেন, ৪ জুনের পর সবাইকে জেলে ভরবো। এই কথা কি প্রধানমন্ত্রীর মুখে শোভা পায়? গোটা দেশে জেল বানান।

নরেন্দ্র মোদীকে আক্রমণ করে তিনি আরও বলেন, এজেন্সি দিয়ে গোটা দেশকে জেল বানিয়ে রেখেছেন। আমরা আপনাকে ভয় পাই না। আপনাদের যদি সাহস থাকে, জনসাধারণের ভোট নিয়ে লড়াই করুন।

‘তৃণমূল দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের বাঁচাতে চায়’
নরেন্দ্র মোদীও অবশ্য এসবের পাল্টা জবাব দিয়েছেন। রোববার জলপাইগুড়ি জেলার ধূপগুড়ির জনসভা থেকে তৃণমূলকে তোপ দেগে নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, তৃণমূল দেশের আইন এবং সংবিধান লঙ্ঘনকারী দল।

তিনি বলেন, তৃণমূল চায় ওদের গুন্ডাদের সন্ত্রাস করার লাইসেন্স মিলুক। তদন্তকারীরা তদন্ত করতে গেলে ওদের ওপর হামলা করে। অন্যদের দিয়ে হামলা করায়।

সন্দেশখালির প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন তিনি। মোদী বলেছেন, সন্দেশখালিতে আপনারা দেখেছেন, কী হয়েছে। এখানে প্রত্যেক ঘটনায় আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হয়।

কী ঘটেছিল ভূপতিনগরে?
২০২২ সালে অর্জুনপুর পঞ্চায়েতের ভগবানপুর-২ ব্লকের তৃণমূলের বুথ সভাপতি রাজকুমার মান্নার বাড়িতে বিস্ফোরণ হয়। এই ঘটনায় রাজকুমার মান্না, তার ভাই দেবকুমার মান্না ও বিশ্বজিৎ গায়েন গুরুতর আহত হন। পরে তিনজনেরই মৃত্যু হয়।

পুলিশের পক্ষ থেকে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা দায়ের করে তদন্ত শুরু হয়। এই ঘটনায় উপযুক্ত ধারা প্রয়োগ এবং এনআইএ-র হাতে তদন্তভার তুলে দেওয়ার আর্জি জানিয়ে কলকাতা হাই কোর্টে হলফনামা দায়ের করা হয়।

পরে এই ঘটনার তদন্তের ভার এনআইএ-র হাতে তুলে দেওয়া হয়। তদন্তে উঠে আসে তৃণমূলের বুথ সভাপতি মনোব্রত জানা ও বলাইচরণ মাইতির নাম।

প্রসঙ্গত, বিস্ফোরণে রাজকুমার মান্নার মৃত্যুর পর নাড়ুয়াবিলার তৃণমূলের বুথ সভাপতি হন মনোব্রত মান্না। আর অর্জুননগরের অঞ্চল সভাপতি হলেন বলাইচরণ মাইতি।

তাদের খোঁজ চালাতেই শনিবার এনআইএ-র দুটি দল ভূপতিনগরে পৌঁছায়। সঙ্গে ছিল আধা সামরিক বাহিনীও।

একটি দল যায় নাড়ুয়াবিলা গ্রামে মনোব্রত জানার খোঁজ করতে যায়, অন্যটি যায় নিচ নাড়ুয়া গ্রামে বলাইচরণ মাইতির খোঁজে। বিস্ফোরণের ঘটনায় যুক্ত থাকার অভিযোগে তাদের আটক করা হয়।

তাদের ভূপতিনগর থানায় নিয়ে গিয়ে গ্রেফতার করা হবে এমনটাই স্থির করা হয়েছিল। কিন্তু এনআইএ’র অভিযানের খবর ছড়িয়ে পড়লে কর্মকর্তাদের ওপর চড়াও হন গ্রামের কিছু মানুষ। তাদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়, গাড়ি ভাঙচুর করা হয় বলে অভিযোগ।

এই ঘটনায় এনআইএ’র একজন কর্মকর্তা আহত হন বলে জানানো হয়েছে এবং পুলিশের কাছে এই মর্মে লিখিত অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে।

পরে দুই ধৃত তৃণমূল নেতাকে কলকাতা নিয়ে যাওয়া হয় এবং বিশেষ আদালতে পেশ করা হয়। আগামী বুধবার (১০ এপ্রিল) পর্যন্ত তাদের এনআইএ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

অন্যদিকে, ভূপতিনগরে তদন্তে যাওয়া কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করেছেন গ্রামবাসীরা। তারা গভীর রাতে দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢুকে নারীদের শ্লীলতাহানি করেছেন, বাড়ি তছনছ করেছেন এবং ধৃতদের পরিবারের ওপর অত্যাচার করা হয়েছে বলে পুলিশে অভিযোগ জানানো হয়েছে। শ্লীলতাহানির ধারাও দেওয়া হয়েছে এনআইএ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে, যা জামিন অযোগ্য।

এনআইএ’র তরফে অবশ্য সব অভিযোগই অস্বীকার করা হয়েছে।

ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভূপতিনগরে তল্লাশি নিয়ম মেনেই চালানো হয়েছিল। তাদের সঙ্গে ছিলেন সিআরপিএফ জওয়ান ও নারী কনস্টেবলরাও। এই ঘটনাকে নিয়ে ‘বিতর্ক’কে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলেও মন্তব্য করা হয়েছে।

গত রোববার জাতীয় অনুসন্ধানকারী সংস্থার বিবৃতিতে বলা হয়, মহামান্য কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে ২০২৩ সালের ৬ জুন একটি বিস্ফোরণ সংক্রান্ত মামলার তদন্তভার হাতে নেই আমরা। সেই মতোই শনিবার নড়ুয়াবিলা গ্রামে তল্লাশি অভিযান চালানো হয়েছিল।

বিস্ফোরণ কাণ্ডে ধৃত দু’জনকে স্থানীয় থানায় নিয়ে যাওয়ার সময় উত্তেজিত জনতা ‘বিনা প্ররোচণায়’ তদন্তকারীদের ওপর হামলা চালায় বলে তারা জানিয়েছে। তাতে একজন কর্মকর্তা আহত হন এবং তাদের গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ধৃতদের নিয়ম মেনেই গ্রেফতার করা হয়েছে এবং এই পুরো অভিযান একেবারেই ‘অনৈতিক’ নয় বলেও দাবি করা হয়েছে ওই বিবৃতিতে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com