রমজানে যেসব প্রশিক্ষণ পায় রোজাদার

0

রমজানের শেষ সময় অতিবাহিত হচ্ছে। চূড়ান্ত আত্মশুদ্ধি অর্জনের পথে রোজাদার। তারাবি, তাহাজ্জুদ, কোরআন তেলাওয়াত ও ইতেকাফসহ মাসব্যাপী রোজা পালন ও ক্ষমা প্রার্থনায় তাওবা-ইসতেগফারে নিয়োজিত রোজাদার। রোজাদারের প্রশিক্ষণের মাস রমজান। রমজান পরবর্তী জীবনের গুনাহ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে চূড়ান্ত প্রশিক্ষণও নিচ্ছে রোজাদার। এতে মহান আল্লাহর বিশেষ তিনটি গুণের প্রশিক্ষণও রয়েছে। রমজানে রোজাদারের সেই প্রশিক্ষণ ও গুণগুলো কী?

পাপমুক্ত জীবন গঠনে মনোযোগী হবেন রোজাদার। কেননা পবিত্র রমজান মাস থেকে মুমিন বান্দা মহান রবের অনন্য ৩টি গুণে নিজেদের রঙিন করে নিয়েছেন। এ তিনটি গুণই সব রোজাদার জন্য জীবন আলোকিত করার তিনটি বিশেষ প্রশিক্ষণ। তাহলো-

১. কম কথা বলার অভ্যাস।

২. কম ঘুমানোর অভ্যাস। আর

৩. খাবার থেকে বিরত থাকার অভ্যাস।

পুরো রমজান মাসজুড়ে রোজাদার বান্দা গরিব-অসহায় মানুষের ক্ষুধার যন্ত্রণা অনুভব করে। আল্লাহ তাআলা যে উদ্দেশ্যে বান্দার প্রতি রোজা ফরজ করেছেন, সে মোতাবেক প্রত্যেক রোজাদার রমজানের প্রশিক্ষণ পেয়ে ধন্য হয়। নিজেদের জীবনকে আলোকিত করতে এবং গুনাহমুক্ত জীবন গড়তে রমজানের এ প্রশিক্ষণ ও গুণগুলো অর্জন করার বিকল্প নেই। এ ছাড়াও আরও কিছু আমলের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা জরুরি। তাহলো-

তাকওয়া বা আল্লাহর ভয় অর্জন

রোজা পুরোপুরি শারীরিক কিংবা আর্থিক ইবাদত নয়, বরং তা হচ্ছে আত্মিক ইবাদত। বাহ্যিক দৃষ্টিতে রোজা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। তাই রোজাদার মনে প্রাণে আল্লাহকে ভয় করে এবং ভালোবেসেই আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নে রোজা রাখে। আল্লাহকে ভয় করেই রোজাদারের সারাদিন পানাহার থেকে বিরত থাকে। তাকওয়া বা আল্লাহর ভয় অর্জনে নিজেকে নিয়োজিত রাখে। যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন মহান আল্লাহ-

 یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الصِّیَامُ کَمَا کُتِبَ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়াবান হতে পার।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)

রোজাদারের এ ভয় এবং ভালোবাসা বছরের বাকি ১১ মাস অব্যাহত থাকার জন্য এ রমজানে তাকওয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার বিকল্প নেই। মুমিন বান্দা রমজানের রোজা থেকেই এ প্রশিক্ষণ পায়।

ধৈর্য ধারণের প্রশিক্ষণ

রমজানকে সবরের মাস বলা হয়। রোজাকে সবরের অর্ধেক বলা হয়েছে। এ মাসেই বান্দা সবরের শিক্ষা লাভ করে। সবরকারীর জন্য রয়েছে অগণিত পুরস্কার। রোজা মানুষকে আল্লাহর হুকুম পালনে ধৈর্যশীল ও পরমসহিষ্ণু হতে শেখায়। আল্লাহ তাআলা বলেন-

قُلۡ یٰعِبَادِ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوۡا رَبَّکُمۡ ؕ لِلَّذِیۡنَ اَحۡسَنُوۡا فِیۡ هٰذِهِ الدُّنۡیَا حَسَنَۃٌ ؕ وَ اَرۡضُ اللّٰهِ وَاسِعَۃٌ ؕ اِنَّمَا یُوَفَّی الصّٰبِرُوۡنَ اَجۡرَهُمۡ بِغَیۡرِ حِسَابٍ

‘বলুন, হে আমার বিশ্বাসী বান্দাগণ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। যারা এ দুনিয়াতে সৎকাজ করে, তাদের জন্যে রয়েছে পুণ্য। আল্লাহর পৃথিবী প্রশস্ত। যারা সবরকারী, তারাই তাদের পুরস্কার পায় অগণিত।’ (সুরা যুমার : আয়াত ১০)

সহমর্মিতার শিক্ষা নেওয়ার মাস রমজান

সারাদিনের প্রচণ্ড ক্লান্তি সত্বেও ক্ষুধা নিবারণে ইফতারের অপেক্ষায় সবর করে রোজাদার। মানুষ চাইলেই লুকিয়ে পানাহার করতে পারে; আল্লাহর ভয়ই মানুষকে লুকিয়ে খাওয়া বা পান করা থেকে বিরত রাখে।

নিয়মানুবর্তিতার প্রশিক্ষণ

মানুষকে শৃংখলিত জীবনের দিকে পথ-নির্দেশ করে রমজানের রোজা। রমজান এলেই রোজাদার সময় মতো সাহরি খায়, সময় মতো জামাআতে নামাজ আদায় করে, সময় মতো মসজিদে উপস্থিত হয়, সময় মতো ইফতার করে, সময় মতো তারাবিহ পড়ে।

আবার নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কাজগুলো করতে শেখায় রমজান। তাই একজন মানুষ যদি রমজান মাসকে ফলো করে, তবে বাস্তবজীবনে একজন সফল নিয়মতান্ত্রিক মানুষে পরিণত হতে পারে রোজাদার।

পরিশ্রমী হয়ে ওঠার প্রশিক্ষণ

রোজা মানুষকে অলসতামুক্ত হয়ে পরিশ্রমী হতে শেখায়। প্রত্যেক রোজাদার দিনের বেলায় পানাহার ত্যাগ করা সত্ত্বেও নামাজসহ অন্যান্য ইবাদাত-বন্দেগির পাশাপাশি সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে। সারা দিন রোজা রেখে রাতের বেলায় তারাবিহ-তাহাজ্জুদ নামাজ আদয়, কুরআন তেলাওয়াত, জিকির-আজকার করে।

এতকিছুর পরও মানুষ আবার শেষ রাতে ওঠে সাহরি খাওয়া এবং ফজর নামাজ আদায় করা অনেক কষ্টকর। রমজান মাসের রোজার প্রশিক্ষণই মানুষকে পরিশ্রমী হতে শেখায়।

সত্যবাদী হওয়ার প্রশিক্ষণ

সব খারাপ চরিত্র বা আচরণ ধুয়ে-মুছে সুন্দর জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে মানুষ। রমজানের রোজা পালনের মাধ্যমেই মানুষ নিজেকে সত্যবাদী হিসেবে গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ পায়। বিশেষ করে যে ব্যক্তি রোজা রাখেন তিনি কখনও মিথ্যা কথা বলতে পারেন না। মিথ্যা বলতে গেলে নিজে থেকেই একটা খারাপ অনুভূতি জাগ্রত হয়।

তাছাড়া একজন রোজাদার কখনও সজ্ঞানে কোনো অসত্য কিংবা মিথ্যা কথা বলতে পারেন না। কুরআন নাজিলের মাসে কুরআনের বরকতে আল্লাহর রহমতে রোজাদার হয়ে ওঠেন সত্যবাদী।

দায়িত্বশীল হওয়ার প্রশিক্ষণ

রমজানের রোজা একজন রোজাদারকে সব অন্যায়, জুলুম, অত্যাচার নির্যাতনমূলক কাজ-কর্ম করা থেকে বিরত রাখে। পরিবার ও সমাজে যাতে কোনো গর্হিত কাজ না হয় সে ব্যাপারেও সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকে। রোজাদার কাজ-কর্মে, অফিস-আদালতে, ব্যবসা-বাণিজ্যে সব জায়গায় নিজেকে যথাযথ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট রাখে। যা রমজান ব্যতিত অন্য সময় সচারচর দেখা যায় না।

এ জন্যই আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য রমজানের পুরো মাস রোজা পালন ফরজ করেছেন। যার ফলে প্রত্যেক রোজাদার বাকি ১১ মাস রমজানের দায়িত্বশীল হওয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণে আলোকিত জীবন-যাপন করতে পারে।

নিয়মিত নামাজি হওয়ার প্রশিক্ষণ

রমজানের আগেও যে মানুষটি নামাজ পড়তেই অলসতা করত কিংবা ঠিকভাবে নামাজ পড়তো না। রমজান মাসে সেই মানুষটিই নিজে নামাজ পড়ে এবং অপরকেও নামাজের আহ্বান করে। যা আল্লাহর একান্ত অনুগ্রহ।

এ কারণেই রমজান এলে মানুষ মসজিদমুখী হয়। মসজিদ ফিরে পায় প্রকৃত যৌবন। নামাজের প্রথম কাতারে দাঁড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে রোজাদার। এ সবই রমজানের রোজার আলোকিত শিক্ষা। যা পরেও মানুষের জীবনে বাস্তবায়িত হতে থাকে।

কোরআনের বিধান বাস্তবায়নের প্রশিক্ষণ

রমজান এলেই মানুষ আল্লাহর রাস্তায় বেশি বেশি দান-সাদকা করেন। সম্পদশারী ব্যক্তিরা জাকাত আদায় করেন। ব্যক্তি পরিবার ও সমাজরে লোকজন পরিবারের পক্ষ থেকে ফেতরা আদায়ে মনোযোগী হয়। এসবই মহান আল্লাহর নির্দেশ।

রমজান মাসেই মুমিন মুসলমান কুরআন ও হাদিস অনুযায়ী সব বিধিবিধান বাস্তয়নে এগিয়ে আসে। সমাজ ফিরে পায় সোনালী জীবন। অপরাধ-কুসংস্কার দূরভীত হয় সমাজ থেকে। কুরআনের বিধান বাস্তবায়নের ফলে সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সুখ ও শান্তি বিরাজ করে। যা এক অতুলণীয় উপমা।

গুনাহমুক্ত হওয়ার মাস রমজান

আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের বিগত বছরের সব গোনাহ থেকে মুক্ত করে নিষ্পাপ করে দেওয়া জন্য ঘোষণা দিয়েছেন। এ কারণেই মানুষ রমজানে আল্লাহর হুকুম পালন করে গোনাহ মাপের জন্য দিনের বেলায় পানাহার-যৌনাচার ত্যাগ করে এবং রাতের বেলায় তারাবিহ-তাহাজ্জুদ-সাহরির মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত পালন করে।

পক্ষান্তরে আল্লাহ তাআলাও প্রত্যেক বান্দাকে গোনাহ থেকে মুক্তি দিতে এগিয়ে আসেন। যার বাস্তবায়ন শুধুমাত্র রমজানেই সম্ভব। কেননা আল্লাহ তাআলা বান্দার বিগত জীবনের গোনাহ ক্ষমা করে দিতে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম রাত পবিত্র লাইলাতুল ক্বদর রেখেছেন।

আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার প্রশিক্ষণ

রোজাদারের জন্য সেরা প্রাপ্তি ও নেয়ামত হলো জান্নাতে মহান আল্লাহর দিদার বা সান্নিধ্য। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা দিয়েছেন।

রোজা আমার জন্য রাখা হয় আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব। কেননা আল্লাহ তাআলা সব কাজের প্রতিদান দুনিয়াতে ঘোষণা করেছেন শুধুমাত্র রোজার প্রতিদান ছাড়া। রোজাদারের প্রতিদানের চূড়ান্ত ঘোষণা দিবেন- মহান আল্লাহ তাআলা। যার সর্বোচ্চ পর্যায় হচ্ছে আল্লাহর দিদার।’

রমজানে উল্লেখিত গুণ ও প্রশিক্ষণগুলো নিজেদের জীবনে বাস্তবায়নে নবিজীর শেখানো ভাষায় বেশি বেশি দোয়া করা। হাদিসে পাকে এসেছে-

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন-

اَللَّهُمَّ اِنِّى أَسْألُكَ الْهُدَى وَالتُّقَى وَالْعَفَافَ وَالْغِنَى

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল হুদা; ওয়াত তুক্বা; ওয়াল আ’ফাফা; ওয়াল গেনা।

অর্থ : হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে হেদায়েত কামনা করি এবং আপনার ভয় তথা পরহেজগারি কামনা করি এবং আপনার কাছে সুস্থতা তথা নৈতিক পবিত্রতা কামনা করি এবং সম্পদ তথা সামর্থ্য কামনা করি। (মুসলিম, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ ও মুসনাদে আহমদ)

আল্লাহ তাআলা মুমিন মুসলমানকে রমজানের সব প্রশিক্ষণগুলো বছরের বাকি ১১ মাস নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন। কুরআনের বিধানগুলো যথাযথভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com