মারিউপোলের পর এবার সমগ্র ডনবাস হারানোর পথে ইউক্রেন, রাশিয়ার অর্জন ক্ষণস্থায়ী বললেন জেলেনস্কি
গত দুই মাস ধরে চলমান যুদ্ধে সবথেকে বড় সফলতা পেয়েছে রাশিয়া। দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ করে রাখার পর সপ্তাহব্যাপী কঠিন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অবশেষে ইউক্রেনের শহর মারিউপোল দখলে নিয়েছে রুশ সেনারা। যদিও আজভস্টাল স্টিল প্ল্যান্টে লুকিয়ে থাকা ইউক্রেনীয় সেনারা এখনও আত্মসমর্পণ করেনি। তবে তাদেরকে নিয়ে আপাতত ভাবছেন না রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। মারিউপোলের পর এখন দ্রুততার সঙ্গে গোটা ডনবাস অঞ্চল কবজার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এ খবর দিয়েছে ডয়চে ভেলে ও বিবিসি।
এদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়া যে সামরিক জয় পেয়েছে তা ক্ষণস্থায়ী। ইউক্রেনের সেনারা রুশ সেনাদের সীমান্তের ওপাড়ে পাঠিয়ে দেবে।
জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে এই কথা বলেন জেলেনস্কি। এতে তিনি আরও বলেন, দক্ষিণ ও পূর্বে আগ্রাসী শক্তি জয়ের জন্য যা যা করা দরকার করে যাচ্ছে, কারণ তাদের আলোচনা করার জন্য কিছু প্রয়োজন। কিন্তু কোনো কিছুই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাশিয়াকে সাহায্য করবে না। তারা শুধু যুদ্ধে তাদের পরাজয়কে কিছুদিন পিছিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু একসময় তাদেরকে আমাদের ভূমি ছেড়ে যেতেই হবে।
মারিউপোলের পর রাশিয়া এখন তাদের পরবর্তী টার্গেট দখলে এগিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে দনেৎস্ক অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা দখলে নিয়েছে রুশ সেনারা। ইউক্রেনের সেনা প্রধানের গুরুত্বপূর্ণ সহকারি শুক্রবার জানিয়েছেন, দনেৎস্কের অন্তত ৪২টি গ্রাম রাশিয়ার হাতে চলে গেছে। দেশের জাতীয় টেলিভিশনে তিনি এই কথা জানান। তবে ওই গ্রামগুলো পুনরায় দখল করতে ইউক্রেনের সেনারা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি। যে কোনো সময় তা ফের ইউক্রেনের হাতে চলে আসবে বলে আত্মবিশ্বাসী তিনি। ডনবাসে রুশরা সামরিক এবং বেসামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র এবং বোমা হামলা চালাচ্ছে। বৃটিশ প্রতিরক্ষা দফতর জানিয়েছে, ডনবাস অঞ্চলের ক্রামাটোরস্ক শহরে রাশিয়া ক্রমাগত রকেট হামলা চালাচ্ছে। আরও উত্তরে খারকিভের মেয়র জানিয়েছেন, গত ২৪ ঘণ্টা ধরে সেখানে গোলাবর্ষণ চলছে। তিনি শহরের বাসিন্দাদের তাদের আশ্রয় কেন্দ্রের ভেতরেই থাকতে বলেছেন, কারণ দক্ষিণ-পূর্বের ইজিয়ুমে লড়াই চলছে। তিনি বলছেন, শহরে এখনো দশ লাখ মানুষ রয়ে গেছে। তবে ৩০ শতাংশের মতো বাসিন্দাকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই নারী, শিশু এবং বৃদ্ধ। সমর বিশেষজ্ঞ জেনারেল স্যার রিচার্ড ব্যারন্স বলছেন, ডনবাস অঞ্চলের উত্তর-পূর্ব দিকের লড়াইটা রাশিয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে তারা ইউক্রেনিয়ান বাহিনীকে ঘিরে ফেলতে চাইছে। যদি তারা একটা করতে পারে, সেটা হবে তাদের জন্য একটা বড় সাফল্য। যদিও রাশিয়া অবশ্য তাদের হামলা বৃদ্ধি নিয়ে এখনো কোনো বিবৃতি দেয়নি।
এর আগে প্রায় দুই মাস চেষ্টার পর দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ শহর মারিউপোল দখলে নিয়েছে রুশ সেনারা। যুদ্ধের প্রথম থেকেই দেশটির অন্যতম প্রধান টার্গেট ছিল মারিউপোল দখল। কিয়েভ দখলে ব্যর্থ হওয়ার পর রাশিয়ার সব দৃষ্টি গিয়ে পড়ে মারিউপোলের উপরে। শহরটিতে প্রবেশের পরেও বিভিন্ন স্থানে টানা যুদ্ধ চলে কয়েক সপ্তাহ। অবশেষে আজভস্টাল স্টিল প্ল্যান্ট বাদে গোটা মারিউপোল এখন রাশিয়ার দখলে। ওই প্ল্যান্টে এখনও প্রায় ২ হাজার ইউক্রেনীয় সেনা লুকিয়ে আছে বলে পুতিনকে জানিয়েছেন রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই সইগু। তবে প্ল্যান্টের মধ্যে অভিযান পরিচালনা করতে সেনাদের নিষেধ করেছেন পুতিন। উল্টো তিনি বলেন, গোটা এলাকাকে এমনভাবে অবরুদ্ধ করতে হবে যাতে সেখান থেকে একটা মাছিও পালাতে না পারে।
আজভস্টাল শিল্প এলাকা বিশাল বড় একটা এলাকা। এই শিল্পাঞ্চলে মাটির নীচে আছে বহু টানেল ও ওয়ার্কশপ। যেনো সেখানে মাটির নীচে আছে আরেকটি নগরী। ইউক্রেনীয়রা রুশদের বিরুদ্ধে যে ধরণের প্রতিরোধ যুদ্ধে লিপ্ত, সে ধরণের যুদ্ধ চালানোর জন্য এটা আদর্শ জায়গা। তাই রুশরা যদি এই অঞ্চলটি দখল করার জন্য একটি পূর্ণ অভিযান চালায়, তাদের জন্য কাজটা সহজ হবে না। সেজন্যেই প্রেসিডেন্ট পুতিন, এখন এটি দখলের অভিযান চালানোর পরিবর্তে সেটি অবরোধের নির্দেশ দিয়েছেন বলে মনে করছেন সামরিক বিশ্লেষকরা। বৃটেনের একজন সমর বিশেষজ্ঞ, জেনারেল স্যার রিচার্ড ব্যারন্সও সেকথাই বলছেন। তার মতে, এটি দখল করতে গেলে রাশিয়াকে বিরাট মূল্য দিতে হতে পারে, যে ধরণের লড়াই সেখানে হবে, তাতে দুপক্ষেই প্রচুর রক্তক্ষয় হবে। রাশিয়া হয়তো ভাবছে, এই শিল্পাঞ্চলটি দখলে নেয়ার জন্য এত মূল্য দেয়ার কোন মানে আছে কিনা। এমনিতেই আজভস্টাল শিল্প এলাকায় ইউক্রেনীয় সেনারা বিপদে আছে। তাদের রসদ ফুরিয়ে গেছে। কাজেই অবরোধের মাধ্যমেই বরং তাদের আরও বেশি কাবু করা যাবে। তাছাড়া রাশিয়া এখন সমগ্র ডনবাস অঞ্চলের লড়াইয়ের দিকে মনোযোগ দিতে চায়।
এদিকে মারিউপোলে রুশ সেনারা ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে সেখানকার স্থানীয় প্রশাসন। তাদের দাবি, অসংখ্য বেসামরিক মানুষের মৃতদেহ সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে রাশিয়া। বহু মরদেহ ইতিমধ্যেই সরিয়ে নেয়াও হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও বলছে, তারা মারিউপোলের আসেপাশে নতুন কবরের সন্ধান পেয়েছে। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিতে হাজার হাজার নতুন কবর সনাক্ত করা গেছে বলে দাবি দেশটির।