মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে
মুসলিম বিশ্বের প্রায় সব দেশের মধ্যেই এক ধরনের অস্থিতিশীলতা আছে এবং রাজনৈতিক সংকটও কাজ করছে। শুধু তাই নয়, এ দেশগুলোর মধ্যে কতগুলো আঞ্চলিক বিভক্তিও আছে এবং এ বিভক্তি তাদের মধ্যে ঐক্যের বিভক্তিও বলা যায়। আর এ ঐক্যহীনতা মুসলিম দেশগুলোতে অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম দেশগুলোর ভেতরে বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো এবং আরও অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিগুলোতে বহিঃশক্তির যে হস্তক্ষেপ রয়েছে, সেটি মুসলিম বিশ্বের সংহতির জন্য এবং মুসলিম বিশ্বকে সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা।
অবশ্য মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোতে বিরাজমান যে অস্থিরতা, তার সমাধানে ওআইসি, আরব লিগ, গালফ্ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি) কাজ করে আসছে। তবে তাদের পক্ষ থেকে স্থায়ী সমাধানে তেমন কোনো কার্যকরী ভূমিকা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। ইসলামিক উম্মাহ অথবা ইসলামিক সোলিডারিটি গঠন হয়ে উঠছে না। অর্থাৎ ইসলামিক উম্মাহর সত্যিকারের দেখা আমরা পাচ্ছি না। যার ফলে আজকের যে মুসলিম বিশ্ব, সেখানে সন্ত্রাসবাদ থেকে শুরু করে নানা ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। মুসলিম বিশ্বের সাংগঠনিক ঐক্যের পাশাপাশি অনৈক্যের বিপরীত চিত্রও লক্ষ করা যায়। কারণ বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশের মধ্যে পরস্পরের প্রতি এক ধরনের প্রতিযোগিতা কিংবা পরস্পরের প্রতি এক ধরনের অবিশ্বাস কাজ করে যাচ্ছে।
যার ফলে একে অপরের প্রতি বিভক্তি বাড়ছে, অনৈক্যের সৃষ্টি হচ্ছে। আর এসব কারণে অনেক সময় উপহাস করে বলা হয়, ওআইসির মতো সংগঠন বা সংস্থা কোনো কাজই করছে না। ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক কিংবা আরব লিগ, এমনকি গালফ্ কো-অপারেশন কাউন্সিল-এ প্রতিষ্ঠানগুলোও মুসলিম বিশ্বের সমস্যা সমাধানে খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। যার ফলে গত দুই দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যের যে দুরবস্থা বিশেষ করে সিরিয়া, ইরাক ও লিবিয়াতে দেখছি, সেটি উদ্বেগজনক। যে দেশগুলো এক সময় মুসলিম সভ্যতার প্রতীক ছিল, শুধু মুসলিম সভ্যতাই নয়, আধুনিক রাষ্ট্র হিসাবেও এ দেশগুলো সফল ছিল-সে দেশগুলোর আজ কী করুণ পরিণতি! আমরা জানি, লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফি, ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন কিংবা সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ, তারা বহু জাতির বহু গোত্রের দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করেছিলেন। সেই রাষ্ট্রগুলো এখন অনেকটা বিভক্তির মধ্যে আছে। যার ফলে এ রাষ্ট্রগুলো এখন বিশ্বের দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
প্যালেস্টানিয়ানদের সমস্যাটি ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হয়ে অদ্যাবধি চলে আসছে। দীর্ঘ সময় ধরে সমস্যাক্রান্ত প্যালেস্টাইন অধিবাসীরা ইসরাইলি দানব দ্বারা নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। ইসরাইলি বাহিনী প্যালেস্টানিয়ানদের ওপর আক্রমণ, নিপীড়ন-নির্যাতন এবং ভূমি দখলে তাদের পেশিশক্তি প্রদর্শন করেই যাচ্ছে। সেই জুলুমবাজ ইসরাইল বহাল তবিয়তে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে মুসলিম দেশগুলোকে অনেকটা অঙুলি নিদর্শন করে সেখানে বীর দর্পে অবস্থান করে যাচ্ছে। বিষয়টি দেখেও যেন দেখার কেউ নেই। ইসরাইলি বাহিনী বেশ কয়েকটি যুদ্ধে মুসলিম দেশগুলোকে পরাজিত করে তাদের দখলকৃত মূল ভূমিকে আরও বিস্তৃত করেছে। বর্তমানে ওয়েস্ট ব্যাংক, গাজা-এ এলাকাগুলো দখলে নিয়ে ক্রমাগতভাবে প্যালেস্টানিয়ানদের ওপরে এক ধরনের হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল।
প্যালেস্টানিয়ানদের প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে সুযোগ বা স্বপ্ন ছিল, ইসরাইলের আগ্রাসী ভূমিকার কারণে সেটার বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। এত কিছুর পরও মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো প্যালেস্টানিয়ানদের পক্ষে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। প্যালেস্টাইন সমস্যাটির সমাধান তো দূরের কথা, বরং আমরা দেখতে পাচ্ছি ইসরাইলকে কেন্দ্র করে মুসলিম বিশ্বের ভেতরেও এক ধরনের বিভাজন তৈরি হয়েছে। আমরা সম্প্রতি লক্ষ করেছি, আরব আমিরাত ও বাহরাইনের মতো দেশগুলো ইসরাইলকে এক ধরনের কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সঙ্গে সু-সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। প্রকারান্তরে প্যালেস্টানিয়ানদের সমস্যাকে অনেকটা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে তারা। যার ফলে দীর্ঘ সময় ধরে এ সমস্যাটি চলমান আছে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ইসরাইলকে কঠিন হুশিয়ারি দিয়ে ফিলিস্তিন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেছেন, আগামী এক বছরের মধ্যে ইসরাইলকে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ছাড়তে হবে। নতুবা রাষ্ট্র হিসাবে ইসরাইলকে দেওয়া স্বীকৃতি প্রত্যাহার করা হবে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ভূমি দখলের বৈধতার প্রশ্নে প্রয়োজনে ফিলিস্তিনিরা আন্তর্জাতিক আদালতে যাবে। ১৯৬৭ সালে গাজা অঞ্চল দখল করে নেয় ইসরাইল। এরপর গত প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় ধরে ইসরাইল ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মনে করছে, দুপক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব সমাধানের একমাত্র পথই হচ্ছে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা। কিন্তু এ সমাধানের তেমন কোনো পথ আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ঘটনাটি যে ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ঘটেছে সেটি অনেকটা বিস্ময়কর ছিল। কারণ মার্কিন সেনারা দ্রুত গতিতে এবং এক ধরনের মিস ম্যানেজমেন্টের মধ্য দিয়েই তাদের সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহারের ফলে সেখানে তালেবানদের নতুন করে ক্ষমতায় আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়। তালেবান শাসকগোষ্ঠী ২০০১ সালে ক্ষমতা হারানোর পরে এদেশটিতে টানা ২০ বছর যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যের উপস্থিতি এবং তাদের মিত্র ন্যাটোর যৌথ উপস্থিতি বহাল ছিল।
কিন্তু আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ফলে সেখানে একটি নতুন শূন্যতা তৈরি হয়। এই শূন্যতার ফলে চীন এবং পাকিস্তান নতুনভাবে আফগানিস্তানে তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করে। যদিও তালেবানদের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক আগে থেকেই ছিল। অন্যদিকে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে পিছটান দেয়। যার ফলে এ পরিস্থিতিতে আমরা লক্ষ করি যে বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরে ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। এ অঞ্চলে পরাশক্তি এবং বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা প্রতিযোগিতা সেটি নতুন রূপ লাভ করে।
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ফলে তালেবান শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা গ্রহণের পর এক মাসের মাথায় এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে যা বিশ্বজুড়ে সমালোচনার মুখে পড়ে। চুরির শাস্তি হিসাবে হাত কাটার শাস্তি ঘোষণা করেছে তালেবান। মেয়েদের স্কুলে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। নারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারছে না। বিক্ষোভে গুলি ছুড়ে হত্যা করা হচ্ছে নারীদের। বিষয়গুলো অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত দেশের জন্য খুবই হতাশাজনক। অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ কাতার আফগানিস্তানের এসব বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছে এবং এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে তালেবানকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
বিশ্বে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের এবং স্নায়ুযুদ্ধের পরপর যে বাস্তবতা ছিল সেখান থেকে বেরিয়ে বর্তমানের যে বাস্তবতা আমরা দেখতে পাই, সে বাস্তবতা আরও কঠিন এবং আরও সংকটময়। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে আমি মনে করি, বর্তমানের বহু মেরুকেন্দ্রিক বিশ্ব বাস্তবতায় মুসলিম বিশ্ব যদি একসঙ্গে কাজ করে এবং মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে যদি ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এ দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। সেটি বিশ্বের উন্নয়নের জন্য হোক, নিরাপত্তার জন্যই হোক বা বাণিজ্যের জন্যই হোক অথবা পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধের জন্যই হোক বা সন্ত্রাসবাদ দমনের জন্যই হোক-প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যকার যে বিভক্তি সেটির অবসান হওয়া খুবই প্রয়োজন। বর্তমান সময়ে মুসলিম বিশ্ব যে কঠিন সমস্যা মোকাবিলা করছে, সেটি ভ্রাতৃঘাতী বা আত্মঘাতী।
ইয়েমেনের যুদ্ধই সেটি বলে দিচ্ছে। সুতরাং ইয়েমেন সংকট দূর করার জন্য মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আত্মঘাতী যুদ্ধ হচ্ছে প্যালেস্টানিয়ানদের সঙ্গে ইসরাইলের। সেখানে প্যালেস্টানিয়ানদের পাশে দাঁড়ানো খুবই জরুরি। সন্ত্রাবাদ দমনের ক্ষেত্রে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করার যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর ভেতরে অনেক দেশ আছে যেগুলোর দায়িত্ব ব্যাপক, এ দেশগুলোকে মুসলিম বিশ্বের অস্থিরতা নিরসনে একটি তহবিল গঠন করে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যেতে হবে।
ভূ-রাজনৈতিক কারণে এবং কূটনৈতিক কারণে মুসলিম বিশ্বের যে ভূমিকা সেটি সবসময়ই বজায় ছিল এবং এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। বিশ্বের রাজনীতিই বলি, অর্থনীতি কিংবা নিরাপত্তার কথাই বলি, সবক্ষেত্রেই ঐক্যবদ্ধ মুসলিম বিশ্ব গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করতে পারে। এ ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এবং বিভাজন ভুলে সমন্বিতভাবে কাজ করার মানসিকতাকে জাগ্রত করতে হবে।
ড. দেলোয়ার হোসেন : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়