চীন নিয়েও আছে পুতিনের গোপন পরিকল্পনা!

0

চীনের সাথে রাশিয়ার কৌশলগত সম্পর্ককে এখন অনেকে অবিচ্ছেদ্য হিসাবে দেখতে চান। দু’দেশের শীর্ষ নেতাদের কথায়ও সেরকমই মনে হয়। কিন্তু রুশ কৌশলবিদ ও দার্শনিক আলেকজান্ডার ডুগিন চীনকে রাশিয়ার আধিপত্যের সামনে চ্যালেঞ্জ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেছেন, চীন রাশিয়ার জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। এজন্য অবশ্যই, সর্বোচ্চ মাত্রায়, ভেঙে ফেলা উচিত চীনকে। ডুগিন পরামর্শ দেন, রাশিয়া যেন তিব্বত-জিনজিয়াং-অভ্যন্তরীণ মঙ্গোলিয়া-মাঞ্চুরিয়াকে নিরাপত্তা বেল্ট হিসেবে গ্রহণ করে। রাশিয়ার উচিত চীনকে দক্ষিণ দিকে- ইন্দোচীন (ভিয়েতনাম ব্যতীত), ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়াকে ভূ-রাজনৈতিকভাবে সাহায্য করা। একই সাথে রাশিয়ার উচিত জাপানকে কুরিল দ্বীপপুঞ্জ অফার করে এবং আমেরিকা-বিরোধিতা উস্কে দিয়ে জাপানি রাজনীতিতে পরিবর্তন আনা। এ ছাড়া মঙ্গোলিয়াকে ইউরেশিয়া-রাশিয়ায় বিলীন করা উচিত।

এ কারণে পশ্চিমা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের জন্য ডুগিনের রহস্যময় মেগালোম্যানিয়াকে গুরুত্বসহকারে নেয়া যতটা গুরুত্বপূর্ণ, চীনের শি জিনপিংয়ের জন্য এটি তার চেয়েও বেশি জরুরি মনে হয়। শি এবং পুতিন যুক্তরাষ্ট্রকে আটকাতে গত মাসে একটি অংশীদারিত্ব ঘোষণা করেন। তবে ডুগিনের মতে, চীনকেও পতনের মুখে পড়তে হবে। ডুগিন লিখেছেন, এশিয়ায় রাশিয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য ‘আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নকরণ, বিভক্তি এবং (চীনা) রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিভাজনের প্রয়োজন হবে। ডুগিনের মতে, দূরপ্রাচ্যে রাশিয়ার স্বাভাবিক অংশীদার হলো জাপান।’

ইউরোপের সাথে সংঘাতে জ্বালানি বাজার সঙ্কুচিত ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে চীনের বাজার ও অর্থনৈতিক সহায়তার বিকল্প নেই এখন মস্কোর সামনে। কিন্তু চীন ও রাশিয়া কোন পক্ষই এই মৈত্রীকে অবিচ্ছেদ্যতার পর্যায়ে নিচ্ছে বলে মনে হয় না। বেইজিং ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানকে সরাসরি সমর্থন করেনি। জাতিসঙ্ঘে এই ইস্যুতে ভোটদানে বিরত থেকেছে। সুইফট নিষেধাজ্ঞার পর চীনের নিয়ন্ত্রণে চলা বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো রাশিয়া ও বেলারুশের সাথে আর্থিক লেনদেন বন্ধ রেখেছে। অন্য দিকে চীনের সাথে ভারতের সর্বাত্মক সঙ্ঘাতের সময় মস্কো দিল্লিকে এস ৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহ করেছে। ডুগিনের মতবাদ ও পুতিনের কর্মকাণ্ডে মনে হতে পারে চীন-রাশিয়া সহযোগিতার সম্পর্ক কেবলই প্রয়োজনের সম্পর্ক। যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ বৈরিতা দুই শক্তিকে মাঝে মধ্যে একই বিন্দুতে ঠেলে দেয়।

প্রধান লক্ষ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
আলেকজান্ডার ডুগিনের মতবাদে প্রধান লক্ষ্যই হলো যুক্তরাষ্ট্র। পুতিনের ঘোষিত অঘোষিত লক্ষের সাথে এর কোনো পার্থক্য নেই। ডুগিন বলেছেন, রাশিয়ার উচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে অস্থিতিশীলতা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদে ইন্ধন দিতে ‘আফ্রো-আমেরিকান বর্ণবাদীদের’ উস্কে দেয়া। তিনি আরো বলেছেন, রাশিয়ার উচিৎ, ‘আমেরিকার অভ্যন্তরীণ কার্যকলাপে ভূ-রাজনৈতিক ব্যাধি প্রবর্তন করা, সব ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং জাতিগত ও সামাজিক দ্বন্দ্ব উৎসাহিত করা, চরমপন্থী, বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীসহ সব ভিন্নমতের আন্দোলনকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করা। এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে।’

ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশ হওয়া গত ২২ মার্চের এ সংক্রান্ত এক কলামেও ট্রাম্পের বিদায়কালে ক্যাপিটল হিলের ঘটনার সাথে আমেরিকান রাজনীতিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতাকে সমর্থন করার ডুগিনের পরামর্শ বাস্তবায়নের যোগসূত্র থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হয়। এতে বলা হয়, মার্কিন কংগ্রেসের করিডোরে জানালা ভাঙা দাঙ্গাবাজ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের ব্রেক্সিট এবং রাশিয়ান প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর জার্মানির ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা দেখে ডুগিন অবশ্যই অনুভব করেন যে, পুতিন শাসনে জিনিসগুলো ঠিকঠাক এগিয়ে চলছে।

আমেরিকান ফাইভ আই (ইংরেজি ভাষাভাষি ৫ দেশ)-এর বিপরীতে জার্মান-ফ্রান্স অক্ষ তৈরির প্রচেষ্টার পেছনে একই লক্ষ সক্রিয় থাকতে পারে। ডুগিন আমেরিকান বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রভাব খর্ব করতে দেশটির অভ্যন্তরে জাতীয়তাবাদী উগ্রপন্থা উস্কে দিয়ে দেশটিকে রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত করে রাখার পাশাপাশি বিকল্প বিশ্বব্যবস্থা তৈরির কথাও বলেছেন, যার মধ্যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও অন্তর্ভুক্ত। পুতিন এখন চীনা নেতা শি জিন পিংয়ের সাথে মিলে সেটি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছেন। এই এজেন্ডায় চীন ও রাশিয়ার স্বার্থ একই বিন্দুতে। রাশিয়ার মতো চীনও তাইওয়ানকে ঘিরে এক সময় একই ধরনের নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়তে পারে। নিষেধাজ্ঞার এই অস্ত্রকে ভোঁতা করতে সুইফটের বিকল্প টিপস এবং বৈশ্বিক ডিজিটাল মুদ্রা প্রচলন ও জাতীয় মুদ্রায় বাণিজ্যিক লেনদেন করার ব্যবস্থা নিয়ে বেইজিং কাজ করছে। এতে চীনের চাইতে রুশ স্বার্থও কোনো অংশে কম নয়।

তবে এই উদ্যোগ বিশ্ব ব্যবস্থায় আমেরিকা তথা পশ্চিমা বলয়ের আধিপত্য অবসানের এক চূড়ান্ত প্রয়াস, যা ওয়াশিংটনের জন্য কোনোভাবেই মেনে নেয়ার মতো নয়। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশ পুতিনের অভিযানে আমেরিকা বা পাশ্চাত্যের একাধিপত্যে ভারসাম্য আনার প্রচেষ্টা দেখতে পাচ্ছেন। তারা ভাবছেন এর মাধ্যমে স্নায়ুযুদ্ধকালীন ভারসাম্য আবার ফিরে আসবে। কিন্তু রুশ সাম্রাজ্যের স্বপ্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে রাশিয়ার প্রতিবেশী কোনো দেশ স্বাধীনতা নিয়ে নিরাপদ থাকবে না। নানা সঙ্কট দেখা দিলেও যুক্তরাষ্ট্র তার বাড়ির কাছের কিউবা বা ভেনিজুয়েলাকে সহ্য করে গেছে। পুতিনের মনোভাবে সেই সহনশীলতার দেখা মেলে না।

কিন্তু রুশ আগ্রাসনে সে অভিজ্ঞতা হচ্ছে আশপাশের দেশগুলোর। পুতিনের ‘মস্তিষ্ক’ ডুগিনের মতবাদের পুরোটা বাস্তবায়ন হলে যা দাঁড়াবে তা কেবল কল্পনাতে আনলেও গা শিউরে ওঠে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com