ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্ব রাজনীতির ‘ব্যাক সিটে’ চীন?
ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বারবার আহ্বান জানিয়েছে চীন। যুদ্ধ বন্ধ করতে রাশিয়াকে চাপ দেওয়া থেকে শুরু করে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেনি দেশটি। যে যুদ্ধে ইতোমধ্যে কোটি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন, হাজারো মানুষের প্রাণহানি হয়েছে, হুমকির মুখে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি, এমনকি খাদ্য নিরাপত্তাও।
যুদ্ধের ইতি ঘটাতে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে বিশ্বনেতাদের আবেদনের পরও চীন নিজেদের দূরে রেখেছে। শান্তির আহ্বান জানিয়েছে কিন্তু মধ্যস্থতাকারী বা আলোচনা আয়োজনে এগিয়ে আসেনি। এমন উদ্যোগ তাদের চেয়ে কম শক্তিশালী ফ্রান্স, তুরস্ক ও ইসরায়েলের ওপর ছেড়ে দিয়েছে।
ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে আরও সক্রিয় ভূমিকা চীনের জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকিপূর্ণ। আর এই ঝুঁকি নিতে নারাজ চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এর বদলে রাশিয়ার আক্রমণে আন্তর্জাতিক নিন্দা ও সবচেয়ে পরাক্রমশালী মিত্রের সমর্থনে সতর্করেখায় চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চীন।
এর ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, চলমান যুদ্ধে কূটনৈতিকভাবে চীন আড়ালে চলে গেছে, নিজেদের অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাবকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ বা অনিচ্ছুক।
সিউলের ইয়নসেই ইউনিভার্সিটির চাইনিজ স্টাডিজের অধ্যাপক জন ডেলুরি বলেন, শি যদি সত্যিকার অর্থে সংঘাতের অবসান চাইতেন তাহলে কয়েক দশক ধরে বিশ্ব রাজনীতিতে বড় শক্তি অর্জনকারী চীনের এমন নখদন্তহীন প্রতিক্রিয়া দেখা যেতো না।
বেইজিংয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এই সংঘাতের অবসান দেখতে চান। গত শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে এক ভিডিও কলে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দুই ধাপের মনোভাবের কথা বলেছেন– যুদ্ধবিরতি ও মানবিক সহযোগিতা।
অবশ্য এটি স্পষ্ট নয়, চীনের অবস্থান রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে জিনপিং তুলে ধরেছেন কিনা। সর্বশেষ দুই নেতা কথা বলেছিলেন ২৪ ফেব্রুয়ারি, যেদিন ইউক্রেন সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। এরপর আর দুই নেতার মধ্যে কোনও আলাপ হয়নি। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে এখন পর্যন্ত কথা হয়নি চীনা প্রেসিডেন্টের।
লড়াই যত দীর্ঘ হচ্ছে, ইউক্রেনের মানুষের দুর্ভোগ যত বাড়ছে, চীনের কূটনীতিকদের তত বেশি বেইজিংয়ের অবস্থানের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে হচ্ছে। তারা ইউক্রেনে মানবিক সহযোগিতা পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কিন্তু এই মানবিক সংকট সৃষ্টির জন্য রুশ সরকারের সমালোচনা করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।
ইউক্রেনে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ফ্যান জিয়ানরং লেভিভে বলেছেন, দেশটির জন্য চীন একটি মঙ্গলজনক বাহিনী এবং সংঘাতে ইউক্রেনের একতার প্রশংসা করেছেন। অথচ বেইজিং বেইজিং এখন পর্যন্ত রুশ অভিযানকে আক্রমণ বলতে রাজি হয়নি।
রাশিয়ার সমালোচনা করতে ব্যর্থতার ফলে নিজেকে নিরপেক্ষ শক্তি হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াসও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিবিএস’র একটি অনুষ্ঠানে রাশিয়ার সমালোচনা করতে ব্যর্থতার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত কিন গ্যাংয়ের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নির্বোধ হবেন না। সমালোচনায় সমস্যার সমাধান হবে না।
‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ পরিস্থিতিতে চীন
রাশিয়ার ইউক্রেনে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউরোপে তাৎপর্যপূর্ণ ঐক্য দেখা গেছে। মহাদেশটিতে চীনের অবস্থান নিয়ে কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হচ্ছে। ১ এপ্রিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও চীনের মধ্যকার নির্ধারিত সম্মেলনের আগে এই মনোভাব তৈরি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রও হুমকি দিয়েছে রাশিয়াকে অর্থনৈতিক বা সামরিক সহযোগিতা করলে নিষেধাজ্ঞায় পড়তে হবে চীনকে।
চীনের এই নীতির নেপথ্যে রয়েছে রাশিয়ার সঙ্গে দেশটির গভীর সম্পর্ক এবং পুতিনের সঙ্গে চীনা প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত সম্পর্ক। এই সম্পর্কে ইউক্রেন যুদ্ধ একটি ফাটল ধরিয়েছে কিন্তু বন্ধন ছিন্ন হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর বিরুদ্ধে পুতিনের মনোভাবও লালন করেন চীনা কর্মকর্তারা। ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরোধিতা করেন চীনা কর্মকর্তারা। রাশিয়ার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক নিষেধাজ্ঞার সমালোচনাও করেছে বেইজিং।
বেইজিংয়ের এমন নীতি গ্রহণের পেছনে আরও যে বিষয়টি কাজ করছে তা হলো, রাশিয়াকে চাপ দিলে চীনের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির মিত্রদের কাছে শক্তিশালী হবে। কিন্তু একই সময়ে চীন রাশিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার মতো অবস্থানে নেই।
রাশিয়া ও জাতিসংঘে সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বিলাহারি কাউসিকান বলেন, রাশিয়ার মতো কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ আর কোনও মিত্র নেই চীনের। এটিই হলো শেষ কথা। তারা এমন কিছু করবে না যাতে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জটিলতায় পড়ে এবং ক্ষমতায় পুতিনের নিয়ন্ত্রণ খর্ব হয়।
ওয়াশিংটনের কর্মকর্তারা উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে চীনের কূটনীতির তুলনায় ইউক্রেন ইস্যুতে চীনা প্রেসিডেন্টের অবস্থানকে শঠতাপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করছেন। পিয়ংইয়ংকে পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করতে বলেছে কিন্তু জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে উঠতে জ্বালানিসহ অন্যান্য পণ্য সরবরাহ করছে।
কিছু ক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি চীনের আন্তর্জাতিক কূটনীতির জন্য বেশ সফলতা এনেছে। ২০০৫ সালে ঐতিহাসিক চুক্তির জন্য বেশ কয়েক দফা আলোচনা আয়োজন করেছে, এক বছর পর চুক্তিটি ভেস্তে যায়। এরপর আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে অবস্থান ছিল সীমিত।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হলেও চীন বেশিরভাগ সময় নেতৃত্বদায়ী শক্তির চেয়ে সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে এর অর্থ ছিল রাশিয়াকে সমর্থন করা। ইউক্রেনে যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন রাশিয়াকে নিন্দা জানিয়ে উত্থাপিত প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকা তিনটি দেশের একটি চীন। রাশিয়া এই প্রস্তাবে ভেটো দেয়। এর ফলে অনেকেই ভাবতে শুরু করেছেন দুই দেশের সম্পর্কে হয়তো ফাটল ধরতে যাচ্ছে। যদিও এরপর থেকে রাশিয়াকে ধারাবাহিকভাবে কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
জি২০ সম্মেলনে রাশিয়ার আক্রমণের বিষয়টি উত্থাপনে ইউক্রেনের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে চীন। এই বছরেই ইন্দোনেশিয়ায় এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলেন, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার শীর্ষ ফোরাম জি২০। এটি ইউক্রেন পরিস্থিতির মতো রাজনৈতিক নিরাপত্তা ইস্যু আলোচনার উপযুক্ত স্থান নয়।