‘ইউরোপে শান্তির বন্ধন কেন চিরকালই ভঙ্গুর, সুদূরপরাহত?’

0

কিছু সংকট পায়ের নিচের শক্তি জমিনকেও নাড়িয়ে দেয়। ইতিহাসের ‘টেকটোনিক প্লেট’ স্থান বদলের সে ক্ষণে সংঘাত ইউরোপ মহাদেশকে নতুন বাস্তবতায় গড়ে। আজ স্বীকার করে নেওয়া উচিত, ইউরোপবাসী আবারো তেমন সন্ধিক্ষণ প্রত্যক্ষ করছে।

‘২০২২ সালে এমন হতে পারে, অবিশ্বাস্য!’- অপরিণত এ মন্তব্য বন্ধ করারও সময় এসেছে।

আজ যেমন ইউরোপবাসী নিজেদের চোখ ও কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না—তেমনই পারেনি প্রথম মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে, ১৯১৪ সনে। অথবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রারম্ভে, ১৯৩৯ সালে। তখনও অবধারিতভাবে বলার সুযোগ ছিল না- আসছে বছরগুলো সংঘাতের অন্ধকারে ডুবতে চলেছে। আজ পশ্চিমা দুনিয়া যে ভয়াল যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে, তাতে শুধু ইউরোপ নয় বরং পুরো বিশ্ব জড়িয়ে পড়তে পারে—বেহিসাবি ভুলগুলো করলেই।

মোদ্দাকথা, শান্তি কোনো চিরস্থায়ী ভাগ্যলিখন নয়, সে ভঙ্গুর এক অস্তিত্ব। শান্তির প্রাসাদ গড়ে ওঠে বালির ওপর, তা ধসেও যায় চোখের পলকে। তাই ইউরোপের দূরতম প্রান্তের কোনো ঘটনা আমাদের সকলকে প্রভাবিত করতে পারে নিমিষেই।

ইতিহাসের এমন সন্ধিক্ষণে, সবকিছু আকস্মিক বদলে যায়- এমন বড় সংকটকাল থেকে সঠিক শিক্ষা নেওয়া সহজ নয়। তবে সে চেষ্টা করতেই হবে। তাহলে জানা যাবে, অতীত থেকে শিক্ষা নিতে আগে কখন কখন ভুল হয়েছে।

একটু পেছন ফিরে তাকালে মনে পড়ে ফরাসি সমরনেতা ও তাত্ত্বিক জেনারেল ফার্ডিন্যান্ড ফশের উক্তি। তিনি প্রথম মহাযুদ্ধের অন্তকে সঠিকভাবেই “২০ বছর মেয়াদি” এক অস্ত্রবিরতি বলে সম্বোধন করেন। ভুল বলেননি তিনি, তার অনুমানে মাত্র এক বছর কম পড়েছিল। মহাযুদ্ধের অন্তে বিজয়ী মিত্রপক্ষ জার্মান সাম্রাজ্যের ওপর যে অপমানজনক শর্তারোপ করেছিল- ২১ বছর পর ১৯৩৯ সনে তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের সমীকরণে পশ্চিমারাও একই ভুল করেছে কিনা- সেটাই বর্তমান প্রজন্মের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। যেমন পোল্যান্ডসহ বাল্টিক দেশগুলো যখন গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় যোগ দেয়; তখন আমরা (পশ্চিমা দুনিয়া) উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছি।

এককালে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও চেক প্রজাতন্ত্র সোভিয়েতদের দখলে ছিল। তারা ১৯৯৯ সালে ন্যাটোতে যোগ দেয়। এর পাঁচ বছর পর সামরিক জোটটিতে যুক্ত হয় বাল্টিক রাষ্ট্র- লিথুনিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া। ধীরে ধীরে উবে যেতে থাকে রাশিয়ার প্রভাব।

এ থেকে জন্ম নেওয়া ক্ষোভ আজো পুতিনকে তাড়া করে ফিরছে। মুদ্রার অপরপিঠের এ সত্য নাকচ করা যায় না। পুতিন রাশিয়াকে অপদস্থ, অপমানিত হতে দেখেছেন। অধীনস্থ রাষ্ট্রগুলিকে ন্যাটো সদস্যপদ দিয়ে রাশিয়ার বিদেশি শত্রুর হামলা থেকে রক্ষার ‘বাফার জোন’ কেড়ে নেওয়া হলো- বলে ধরে নিলেন।

এই দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে নিজের জীবনেরই একটি উদাহরণ দিয়েছেন পুতিন, যা হয়তো সত্যও হতে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর একদা রুশ গুপ্তচর সংস্থার কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স শাখার কর্ণেল পুতিন খণ্ডকালীন ট্যাক্সি চালকের কাজ করেছেন। এমন দুর্দশার সময়েই রাশিয়ার হারানো গৌরব উদ্ধারের চিন্তা শুরু করেন।

সেই প্রতিশোধের আগুন থেকেই তিনি হয়তো ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের সিদ্ধান্ত নেন। তাতে পশ্চিমারা রাশিয়ার বিশেষ কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি করতে পারেনি। এ ঘটনা নিঃসন্দেহে পুতিনকে আরও সাহসী করে তোলে।

আরও সাহসী করেছে স্নায়ুযুদ্ধের পর পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর ৩০ বছরব্যাপী সামরিক ব্যয় কমানোর দৃষ্টান্ত।

এতে এক পর্যায়ে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয় যে, জার্মানির ১২৮ ফাইটার জেটের মধ্যে মাত্র চারটি যুদ্ধকালীন মিশনের জন্য প্রস্তুত ছিল। ডাচরা তো তাদের সকল ভারী ট্যাংকগুলো বর্জনের পরিকল্পনাও করে ফেলে। তবে নতুন রাশিয়ার উদয়ে ডাচরা সিদ্ধান্ত বদলায়, জার্মানিও এখন প্রতিরক্ষা খাতে বাড়তি ১০০ বিলিয়ন ডলার খরচের পরিকল্পনা করছে।

জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কলঙ্কিত অতীত নিয়ে ভাবে, সে জন্যই সামরিক ব্যয় নিয়ে এতদিন ছিল সংকোচ। এবার তারা ভবিষ্যতের ভাবনাও ভাবছে।

সোশ্যাল ডেমোক্রেট দল থেকে নির্বাচিত জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ রাষ্ট্রনায়কের আসনে বসে সামরিক ব্যয় বাড়াবেন- হয়তো নিজেও ভাবতে পারেননি। কিন্তু, ঐতিহাসিক এ মুহূর্তের সঙ্গত দাবি পূরণে তিনি কুণ্ঠাও করেননি।

সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়ে তিনি জার্মান পার্লামেন্টে বলেন, “ইউক্রেন আগ্রাসনের শিকার হওয়ায় আমরা এক নতুন যুগে প্রবেশ করলাম। আমরা পুতিনকে অতীত সীমান্ত ফিরিয়ে আনতে দেব নাকি তার মতো যুদ্ধংদেহীকে মোকাবিলায় শক্তি অর্জন করব- সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়েছে।”

ক্রেমলিন থেকে আসা পূবের বাতাসে বৈরীতার আঁচ টের পেয়েছে ন্যাটো জোট বহির্ভূত ধনী ও সামরিক শক্তিতে বলীয়ান দেশ সুইডেনও। দেশটি প্রতিরক্ষা খরচ পাঁচ বছর মেয়াদে বিস্ময়কর ৪০ শতাংশ হারে বাড়াবে। সৃষ্টি করছে পদাধিক সেনার নতুন নতুন রেজিমেন্ট, কিনছে আমেরিকান বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র।

সুইডিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিটার হুলকোভিস্ত বলেছেন, “রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে রাশিয়া সামরিক শক্তি ব্যবহারে প্রস্তুত, আজ আমরা তেমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি।”

তাই রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমারা কেবল অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে- এমন চিন্তাধারার চল উঠে যাচ্ছে। ব্যাংক দিয়ে কী ট্যাংকের বিরুদ্ধে লড়া যায়? তাই বলে পুরো মহাদেশ (ইউরোপ) রণক্ষেত্র হয়ে উঠুক- সেটাও নিশ্চিতভাবেই কেউ চায় না। কিন্তু, পায়ের নিচে জমিন সরে যাওয়ার অনুভূতি যখন হয়, তখন উপায়ান্তরও থাকে না।

আগামী দিনগুলোয় ন্যাটোর সাথে রাশিয়ার সামরিক উত্তেজনা তাই ভয়াল রূপ নেওয়ার ঝুঁকিও সৃষ্টি করছে। তবে ইউরোপ ভাবছে, সামরিক বাহুবল শক্তিশালী করে প্রতিপক্ষ রাশিয়ার ভবিষ্যৎ আগ্রাসন তারা ঠেকাতে পারবে। ইউরোপে বাজছে অস্ত্রসজ্জার এই নতুন দামামা। চিরকালীন এ মহাদেশের ভঙ্গুর শান্তির রেখা তাতে দূরেই মিলাবে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com