দেশে গত তিন বছরে নারী ও শিশু মাদকাসক্ত বেড়েছে তিন গুণ
দেশে গত তিন বছরে নারী ও শিশু মাদকাসক্ত বেড়েছে তিন গুণ। অপরিকল্পিত গর্ভপাতসহ বিভিন্ন কারণে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন নারীরা। উচ্চবিত্ত পরিবারের নারীদের মধ্যে এ নিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার প্রবণতা বাড়লেও, মধ্য ও নিম্নবিত্তের মধ্যে তা বাড়েনি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপে এখনও অধিকাংশ মাদকাসক্ত নারী চিকিৎসার বাইরে। দেশের সরকারি ও বেসরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্রের এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে এ তথ্য।
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর জানিয়েছে, মাদকসেবীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে
কারণ ভিন্ন
বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নারীদের মাদক গ্রহণের কারণগুলো পুরুষদের কারণের চেয়ে অনেকাংশে ভিন্ন। নারীদের ক্ষেত্রে মূল কারণের তালিকায় আছে— বন্ধুদের চাপ, হতাশা, অর্থনৈতিক কারণ, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুসরণ, প্রেমের সম্পর্কে টানাপোড়েন, মাদক ব্যবহারের পারিবারিক ইতিহাস, শারীরিক ও মানসিক সমস্যা, মা-বাবার কলহ, বাল্যবিয়ে, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন ইত্যাদি। মানসিক রোগের কারণেও অনেক নারী মাদক ব্যবহার করে। যেমন— সিজোফ্রেনিয়া, ব্যক্তিত্ব বৈকল্য, বিষণ্নতা।
ঢাকায় আহছানিয়া মিশনের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ডা. ইকবাল মাসুদ নারী রোগীদের চিকিৎসার অভিজ্ঞতার বরাত দিয়ে এসব তথ্য জানান।
এ সংস্থায় চিকিৎসা নিতে আসা ১০৩ জন রোগীর মধ্যে ৩৮ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এদের মধ্যে ১৭ জন নারী রোগীকে কোনও না কোনও সময় অপরিকল্পিত গর্ভধারণের জন্য গর্ভপাত করতে হয়েছিল।
মাদকে নারীর যত ক্ষতি
গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষদের তুলনায় নারীদের মাদকে আসক্তি জন্মায় দ্রুত। এতে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বেশি থাকে। মাদকাসক্ত নারীর জন্ম দেওয়া শিশুর ওজন কম হয়। মানসিক বিকাশেরও ঘাটতি থাকে।
ডা. ইকবাল মাসুদ জানান, “যে নারীরা কোকেইন ও গাঁজা সেবন করে, তাদের সন্তানদের মধ্যে মনোযোগের ঘাটতি, ভাষা ও শিখনদক্ষতা কম দেখা যায়। আচরণগত সমস্যাও দেখা দেয়।
যে নারীরা ইয়াবা গ্রহণ করে তাদের গর্ভের ভ্রূণের বিকাশ কম হয়। গর্ভের শিশুও কম নড়াচড়া করে।
আবার যে নারীরা হেরোইনে আসক্ত হয়, তাদের শিশুদের ভেতরও ওই আসক্তির রেশ থেকে যায়। এ ছাড়া নবজাতকের ওজন কম হয় এবং মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
যারা অ্যালকোহল তথা মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েন তাদের সিরোসিস হওয়ার ঝুঁকি পুরুষের তুলনায় বেশি থাকে।”
মাদকসেবী বাড়ছে
২০২০ থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশের সরকারি ও বেসরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে এই দুই বছরে মাদকসক্ত রোগী বেড়েছে। পুরুষ, নারী ও শিশু তিন বিভাগেই চিকিৎসা নেওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। চিকিৎসকদের ধারণা মাদকের ব্যাপকতা ও সহজলভ্যতার কারণে আসক্তিও বাড়ছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালে সরকারি ও বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্র থেকে ৩০ হাজার ১৩৩ জন মাদকাসক্ত রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এরমধ্যে সরকারি নিরাময় কেন্দ্র থেকে ১৪ হাজার ৯৫২ জন এবং বেসরকারি থেকে ১৫ হাজার ১৮১ জন চিকিৎসা নিয়েছেন।
২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ৩৩ হাজার ৯০৩ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এরমধ্যে সরকারি নিরাময় কেন্দ্র থেকে ১৭ হাজার ৮০৩ ও বেসরকারি থেকে ১৬ হাজার ১০০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন।
নারী-শিশু তিন গুণ
নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে ২০১৯ সালের চেয়ে নারী ও শিশু মাদকসেবী বেড়েছে তিন গুণ।
২০১৯ সালে নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছে ৩৪০ জন নারী ও শিশু রোগী। ২০২০ সালে নিয়েছে ১ হাজার ১৪১ জন এবং ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছে ৯৭৫ জন। দুই বছরেই দেখা যায়, সংখ্যাটা ২০১৯ সালের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি।
নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী
পুরুষ মাদকসেবীদের জন্য দেশে চিকিৎসার অনেক সুযোগ থাকলেও নারী মাদকগ্রহণকারীদের জন্য সেই সুযোগ নেই বললেই চলে। অনেক নারী আবার সুস্থ হতে চাইলেও সামাজিক চাপে সেটা পারেন না।
ডা. ইকবাল মাসুদ বলেন, ‘নারী মাদকাসক্তের চিকিৎসায় পরিবারের সদস্যদের অসহযোগিতা ও আস্থাহীনতার অভাবও বেশি দেখা যায়।’
এ ছাড়া তাদের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থাও অপ্রতুল। কিছু ক্ষেত্রে ব্যয়বহুলও। আবার নারীদের মধ্যে অস্বীকার করার প্রবণতাও বেশি থাকে বলে জানান বিভিন্ন নিরাময় কেন্দ্রের কর্মকর্তারা। অনেক সময় পরিবারও সঠিক তথ্য দেয় না।
উচ্চবিত্ত পরিবারের নারীরা মাদকাসক্তির চিকিৎসা করতে নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে এলেও মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের মধ্যে এ প্রবণতা নেই বললেই চলে।
আবার, সরকারি চারটি নিরাময় কেন্দ্রের মাত্র একটিতে নারীর জন্য আলাদা শয্যা আছে। চিকিৎসা নিতে না আসার এটাও একটা বড় কারণ।
সরকারি চারটি নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে। এর মধ্যে তেজগাঁওয়ে আছে ঢাকা সেন্ট্রাল ট্রিটমেন্ট সেন্টার (সিটিসি)। এখানে নারীদের জন্য বেড আছে মাত্র ১৫টি। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় একটি করে নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। যশোর, রাজশাহী ও কুমিল্লায় নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে জেলখানার ভেতর। তবে পর্যায়ক্রমে বিভাগীয় শহরগুলোতেও মাদক নিরাময় কেন্দ্র চালু করবে সরকার।
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণের অধিদফতরের মহাপরিচালক আব্দুস সবুর মন্ডল বলেন, ‘মাদকাসক্তি একটি রোগ। রোগের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। শিগগিরই এগুলো বাস্তবায়ন হবে।’