বাইডেন কি ইরানের পরমাণু অস্ত্র তৈরি ঠেকাতে পারবেন?
আমরা একটু পেছনে তাকাতে পারি। ২০১৫ সালে চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্যকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) নামের একটি চুক্তিতে (যেটি ‘ইরান চুক্তি’ নামে বেশি পরিচিত) পৌঁছায়।
ওই চুক্তি অনুযায়ী, ইরান তার ইউরেনিয়ামের মজুত কমিয়ে ফেলে। চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব দেশের প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত একটি আন্তর্জাতিক পরিদর্শক দল ইরানের পরমাণু কার্যক্রম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরিদর্শন করে। এর বাইরে ইরান কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করবে না বলেও অঙ্গীকার করে।
বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নিশ্চিত হয়েছেন, ইরান যদি আবার পরমাণু অস্ত্র বানাতে চায়, তাহলে সেই মাত্রার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে তার কমপক্ষে এক বছর সময় লাগবে। ইরান চুক্তির বেশির ভাগ ধারায় যেসব শর্ত দেওয়া আছে, তাতে এই চুক্তি ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
চুক্তিতে উল্লিখিত মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ইরান অপেক্ষাকৃত অনেক কম সময়ের মধ্যে পুরোদমে পরমাণু অস্ত্র কার্যক্রমে চলে যেতে পারবে। ইরান চুক্তিতে সই হওয়ার পরও এখনো ইরানের তহবিলের কোটি কোটি ডলার জব্দহীন অবস্থায় রয়েছে এবং বিশদ অর্থনৈতিক অবরোধের আওতা থেকে ইরানকে উল্লেখযোগ্য পরিসরে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
ইরান প্রথম থেকেই ওই চুক্তি মেনে চলছে। এমনকি চুক্তি স্বাক্ষরের তিন বছর পরে, অর্থাৎ ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চুক্তিটিকে ‘অন্যতম নিকৃষ্ট ও একপক্ষীয় চুক্তি’ বলে তা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরও ইরান চুক্তির প্রতি অনুগত আছে।
ট্রাম্প ইরান চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই নতুন একগুচ্ছ চরম অন্যায্য ও অমানবিক নিষেধাজ্ঞা ইরানের ওপর আরোপ করেছেন। এরপর ইরান তার পরমাণু কার্যক্রম থেকে আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের কিছুটা দূরে রাখা শুরু করে এবং নতুন করে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করার প্রক্রিয়াও শুরু করতে চায় বলে ইঙ্গিত দিতে থাকে।
এখন জো বাইডেন প্রশাসন ইরান চুক্তিতে (ওই চুক্তি স্বাক্ষরের সময় জো বাইডেন ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন) যুক্তরাষ্ট্রকে আবার ফেরাতে চান এবং ইরানকেও এ বিষয়ে সহযোগিতার হাত বাড়াতে অনুরোধ করেছেন।
ইরানেও নতুন নেতৃত্ব এসেছে। নতুন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির নেতৃত্বাধীন সরকার বলেছে, ট্রাম্প ইরানের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে গেছেন, কেবল তা প্রত্যাহার করা হলেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরান আলোচনায় বসতে রাজি আছে। সে সুবাদে এই দুই দেশ যদি আবার ইরান চুক্তিতে ফেরত আসে, তাহলে তার বিনিময়ে ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার সব না হলেও অনেকগুলো নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে। তবে সেটি করা হলে অনেক জটিলতা তৈরি হবে।
প্রথমত, নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর ইরানের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে। এতে ইরান বর্তমানে ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, গাজাসহ এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা যতটুকু নষ্ট করতে পারছে, তখন আরও বেশি অস্থিরতা তৈরি করার সামর্থ্য হাতে পেয়ে যাবে। এসব অঞ্চলে ইরানের তৎপরতা নিয়ে ২০১৫ সালের ইরান চুক্তিতে কিছু উল্লেখ ছিল না।
দ্বিতীয়ত, ইরান আরও ‘দীর্ঘ ও শক্ত’ পরমাণু চুক্তিতে (যা ইরানকে আরও দীর্ঘদিনের জন্য ও আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞায় ফেলবে) সই করবে, এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। এ ছাড়া এটিও বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই যে ইরান কোনো চুক্তির শর্ত হিসেবে তার রাজনৈতিক মতাদর্শ ও লক্ষ্য থেকে মৌলিকভাবে সরে আসবে।
এই অবস্থায় মনে করা যেতে পারে, ইরান তার ওপর আরোপিত অবরোধ শিথিল করার প্রয়োজনে ইরান চুক্তির শর্ত মানবে এবং তার দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত বাড়াতে থাকবে। এরপর ২০৩০ সালের পর চুক্তির মেয়াদ শেষে পূর্ণোদ্যমে পরমাণু কার্যক্রম আবার শুরু করবে। এর বাইরে দেশটি গোপন স্থানে তাদের পরমাণু অস্ত্র তৈরির কাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করে যেতে পারে।
ইরান যদি পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে কিংবা পরমাণু অস্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করায় সক্ষম হয়ে যায়, তাহলে তার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ সৌদি আরব, মিসর ও তুরস্কও সেই পথে হাঁটতে শুরু করবে। এতে গোটা অঞ্চল আগের চেয়ে বেশি অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে।
এ কারণে ইরানকে সে ধরনের পথে হাঁটা থেকে নিবৃত্ত করতে কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি সামরিক দিকটিও ব্যবহার করতে হবে। ইরান তার পরমাণু কার্যক্রম চালালে তার ওপর সামরিক অভিযান চালানো হবে, এই বার্তা তাদের দেওয়া দরকার হতে পারে। ট্রাম্প এবং বাইডেন দুজনই মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকান বাহিনী দিয়ে আর সামরিক অভিযান চালাতে রাজি নন। কিন্তু ইরানের কারণে আর সেই নীতি আঁকড়ে ধরা সম্ভব হবে না।