আফগান সম্মেলন: ইমরানের টার্গেট
আফগানিস্তান ইস্যুতে পাকিস্তান সম্প্রতি একটি সম্মেলন করেছে। এই সম্মেলনের যদিও পাকিস্তান হলো হোস্ট কিন্তু এটা আসলে ‘ট্রয়কা প্লাস’-এর বৈঠক। কোন ‘ট্রয়কা প্লাস’? গত ১৫ আগস্ট তালেবানেরা ক্ষমতা নেয়ার আগে রাশিয়ার উদ্যোগে রাশিয়া, আমেরিকা ও চীনকে নিয়ে তিন দেশীয় গঠন করা হয়েছিল তালেবান-আফগান ইস্যুতে তাদের কমন অবস্থান প্রকাশের জোট, সেটাই ট্রয়কা বা ত্রিদেশীয় জোট। আসলে নিরাপত্তা পরিষদের আফগান ইস্যুতে পাস হওয়া এক সর্বসম্মত প্রস্তাবকে তাদের গঠন ভিত্তি হিসাবে নিয়ে গঠিত হয়েছিল। পরে পাকিস্তানকে ওই ট্রয়কাতে কোঅপ্ট করে নেয়া হয়; কারণ, আফগানিস্তান কোনো কিছু বাস্তবায়ন করতে গেলে পাকিস্তানের মাধ্যমে তা করা অর্থপূর্ণ ও সহজ। অন্তত দুটা কারণে। এক. পাকিস্তান এই প্রথম ২০ বছরের আমেরিকার স্বার্থের যুদ্ধের দায় থেকে মুক্ত হয়েছে। তার পরেও এখনো আফগানিস্তানে অস্থিতিশীলতা ঘটলে তাতে সবচেয়ে বেশি পুরোনা দায় ফিরে আসবে, পাকিস্তান অস্থিতিশীলতায় আক্রান্ত হবে ও সামরিক-অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে পাকিস্তানের। তাই পাকিস্তান না চাইলেও ‘স্থিতিশীল এক আফগান দেখার পক্ষে অবস্থান’ সে নিতে বাধ্য। দুই. আফগানিস্তান কিন্তু এক ল্যান্ডলকড ভূখণ্ড। ফলে পাকিস্তানের সাথে ন্যূনতম একটা তাল মিলিয়ে চলতে আফগানিস্তানও বাধ্য।
অতএব পাকিস্তানকে গ্রুপে নেয়াতে এর নাম হয়ে যায় ‘ট্রয়কা প্লাস’। আর ভারতের জন্য এটা ততোধিক বিব্রতকর হয়ে যায়। কারণ এতে ভারতের অভ্যন্তরীণ পাবলিকের কাছে হিন্দুত্ববাদীরা প্রপাগান্ডা চালাত যে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদ লালনকারী, তা এখানে উল্টে যায়। পাকিস্তান হল জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাব বাস্তবায়নে সন্ত্রাসবিরোধী সবচেয়ে নির্ভরশীল মিত্র, বিশেষ করে এখনকার সময়ের সবচেয়ে শক্তিধর তিন দেশ ও তাদের জোটের নির্ভরশীল মিত্র।
এবার সবচেয়ে কঠিন সত্যটা আগে বলে রাখি। তা হলো, আফগানিস্তানে তালেবানেরা ফেল করলে তাদের বিকল্প বা অন্য শক্তিটা হলো মূলত আইএস আর সাথে ওর সমমনা আরো ছোট ছোট নানা, মূলত ‘পড়শিদেশীয়’ গ্রুপ। সবচেয়ে বড় অস্বস্তিকর বাস্তবতা হলো, যেকোনো পশ্চিমা রাষ্ট্রশক্তি তো বটেই, এমনকি এশিয়া অমুসলিম কেউই বা অন্য ইসলামী ধারা কেউই আইএসের সাথে পাশাপাশি পরস্পরকে স্বীকার করে টিকতে পারবে, তা আইএস তো বটেই কেউই মনে করে না। ফলে তালেবানেরা ফেল করার মানে সবার কাছেই পরিষ্কার।
তাই তালেবানকেন্দ্রিক এখনকার বাস্তবতা হলো, সংশ্লিষ্ট অন্য দেশের এক কমন আকাক্সক্ষা যে, তালেবানেরা ফেল করা নয় বা আইএস আসা নয়। তাই তালেবানদের ফেল করা যাবে না।
কিন্তু জাতিসঙ্ঘকেন্দ্রিক যে গ্লোবাল রাজনৈতিক ব্যবস্থা আছে, তার ভিত্তিতে তালেবানেরা আফগানিস্তান শাসক হিসেবে নিজেদের গড়ে নিক। আর সেই আফগানিস্তান যেন পড়শি যেকোনো দেশে সশস্ত্র হামলাকারী কোনো গোষ্ঠীকে আশ্রয়দানকারী ভূখণ্ড না হয়, এটা নিশ্চিত করতে হবে।
এটা বাস্তবায়নে তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
অনেকে মনে করেন, তালেবানেরা ভাবছে যেহেতু আফগানিস্তান যেন রেডিক্যাল ইসলাম বা আইএস টাইপের সশস্ত্র আন্দোলন বা আক্রমণকারীদের আশ্রয় ভূমি না হয় এটা নিশ্চিত করা প্রায় সারা দুনিয়ার নানান রাষ্ট্রস্বার্থ, কাজেই তালেবানেরা রাজনৈতিকভাবে কেমন শক্তি (আরেকটা আইএস কিনা বা রাজতন্ত্র যেমন এক সালতানাত বা আমিরের দেশ কিনা) তা দেখাদেখি ট্রয়কাকে বিবেচনা বন্ধ করতে হবে বা ছাড় দিতে হবে।
অথবা আফগানিস্তানেও দুর্ভিক্ষ লেগে যেতে পারে এই ভয়ে ট্রয়কাসহ সবাই তালেবানেরা যেমন আছে এভাবেই মেনে নিতে বাধ্য হতে হবে।
তালেবানদের নিজের সম্পর্কে এই অতি-অনুমান যে তারাই হলো দুনিয়াকে স্থিতিশীল রাখার একমাত্র শক্তিÑ এটাই তালেবানদের সব কিছুকে স্থবির করে রেখেছে।
ট্রায়কা উদ্যোগ ফেল করলে, এর প্রথম শিকার হয়ে যাবে আফগানিস্তানের খাদ্য সঙ্কটে থাকা ৫৫% জনগণ।
দ্বিতীয় যেটা সত্য তা হলো, ট্রয়কার তালেবানের সাথে কোনো ছাড় দেয়া যদি ঘটেও সেই তালেবান শক্তির শাসনও ফেল করবেই। ফলাফল হবে, আইএস ও সমমনাদের উত্থান। সেই আফগানিস্তান হবে আফ্রিকার সোমালিয়ার চেয়ে ভয়ঙ্কর কোনো ভূখণ্ড। সারা দুনিয়ার জন্য এক হড়মড় এরিয়া!
লেখক : গৌতম দাস রাজনৈতিক বিশ্লেষক