দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতির কঠোর অবস্থান
সুপ্রিমকোর্টের দুটি শাখা থেকে ৩১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সরিয়ে দিয়েছে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। অ্যাটর্নি জেনারেলের পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতির কাছে অনিয়মের অভিযোগ তোলার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বদলির আদেশ দেয়া হয়।
১ ও ২ ডিসেম্বর তাদের বদলি করা হয় বলে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন জানিয়েছে। তবে একসঙ্গে এত কর্মকর্তা-কর্মচারী বদলির ঘটনা এর আগে ঘটেনি। বদলির এ তালিকায় এফিডেভিট কমিশনার, ফাইলিং শাখার সুপার, এমএলএসএসসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন।
সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের এই বদলি কার্যক্রমকে স্বাগত জানিয়েছেন আইনবিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, এফিডেভিট শাখার সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলির ঘটনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতির কঠোর অবস্থানের প্রমাণ। ভবিষ্যতে এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলে আশা করি।
সুপ্রিমকোর্টের স্পেশাল অফিসার ব্যারিস্টার মো. সাইফুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘১ ও ২ ডিসেম্বর দুটি আদেশে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের ফাইলিং ও এফিডেভিট শাখার ৩১ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে বদলি করা হয়েছে। তারা হাইকোর্টের বিভিন্ন শাখায় বদলি হয়েছেন।’ কী কারণে একসঙ্গে তাদের বদলি করা হল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রশাসনিক কারণে তাদের বদলি করা হয়েছে। এর বেশি কিছু জানি না।’
সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য এটা করা হয়েছে। হাইকোর্টের যেসব শাখায় লোকবল কম, বদলি করা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সেখানে পদায়ন করা হয়েছে। উল্লেখ্য, সোমবার একটি মামলা আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ৩ নম্বর ক্রমিকে থাকার কথা থাকলেও সেটি ৮৯ নম্বর ক্রমিকে দেখা যায়।
এই অনিয়মের বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তখন আদালত বলেন, ‘কী আর করব বলেন? এফিডেভিট শাখায় সিসি ক্যামেরা বসিয়েও অনিয়ম রুখতে পারছি না।’ আপিল বিভাগ বলেন, ‘সিসি ক্যামেরা বসালাম (এফিডেভিট শাখা কক্ষে), এখন সবাই বাইরে এসে এফিডেভিট করে।’
তখন অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘অনেকেই মামলার তালিকা উপর-নিচ করে কোটিপতি হয়ে গেছে।’ আদালত বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষের অনেক আইনজীবীও আদালতে আসেন না।’
এরপর প্রধান বিচারপতি তাৎক্ষণিক এক আদেশে ডেপুটি রেজিস্ট্রার মেহেদী হাসানকে আপিল বিভাগে তলব করেন। তবে মামলার সিরিয়াল করা নিয়ে মেহেদী হাসানের ব্যাখ্যায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন প্রধান বিচারপতি নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ। পরে ডেপুটি রেজিস্ট্রারকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘নরসিংদীর আসাদ অ্যান্ড স্কুল কলেজ সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আসে। হাইকোর্ট সরকারকে বিবেচনা করতে বললেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে আমরা সিপি ফাইল করি। নভেম্বরে প্রথমে আপিল বিভাগে মামলাটি ছিল তিন নম্বরে। পরে সেটি পেছনে চলে যায়। সোমবার বিষয়টি আদালতের নজরে আনলে আদালত বিভিন্ন মন্তব্য করেন।’
মঙ্গলবার বদলি আদেশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘যখনই কোনো প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ঢুকে যায়, তখন সেই দুর্নীতি রোধের জন্য কতগুলো পদক্ষেপ নিতে হয়। প্রধান বিচারপতি গতকালও (২ ডিসেম্বর) বলেছেন, তিনি কঠোর হস্তে এগুলো দমন করার চেষ্টা করছেন। তাই আমি মনে করি, এফিডেভিট শাখায় বদলি তার (প্রধান বিচারপতির) কঠোর অবস্থানের একটি প্রমাণ।’
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সভাপিত এএম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘প্রধান বিচারপতির কাছে কোনো অভিযোগ গেলে তিনি ব্যবস্থা নেবেন- এটাই স্বাভাবিক। এটাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে বলে আমি আশা করি। দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।’
সুপ্রিমকোর্টে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। এর আগে অ্যাটর্নি জেনারেল আরও দু’বার প্রধান বিচারপতির কাছে অভিযোগ করেন। ১৬ মে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চে একটি সিভিল মামলায় (ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড ও অন্যান্য বনাম এম আর ট্রেডিং কোম্পানি ও অন্যান্য) অনিয়মের অভিযোগ তুলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের বিরুদ্ধে ‘অস্বাভাবিক আদেশ’ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর পরামর্শ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২২ আগস্ট গুরুতর অসদাচরণের (আচরণবিধি লঙ্ঘন) অভিযোগে তিন বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত নেন সুপ্রিমকোর্ট।
বিচারপতিরা হলেন, বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, ড. কাজী রেজা-উল হক ও একেএম জহিরুল হক। পরে তারা ছুটিতে যান।
এর আগে ২০১৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি নতুন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের কাছে উচ্চ আদালতের বিচারব্যবস্থায় দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
অ্যাটর্নি জেনারেলের মতে, বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের বিচার বিভাগের অবক্ষয় ঘটছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এ নিয়ে বিচার অঙ্গনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।