গরিব মানুষ কেন করোনার টিকা পাচ্ছে না?
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের টিকা নেয়ার ক্ষেত্রে মানুষের আগ্রহ দিন দিন বাড়লেও সেই কাতারে পিছিয়ে আছে নিম্ন আয়ের মানুষেরা।
বেশিরভাগ কেন্দ্রগুলোয় যারা টিকা নিতে আসছেন তাদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত, শিক্ষিত শ্রেণীতে। কোনো কেন্দ্রেই স্বল্পশিক্ষিত, সুবিধাবঞ্চিত, পিছিয়ে দরিদ্র শ্রেণীর আনাগোনা দেখা যায়নি।
বাংলাদেশে এই শ্রেণীর মানুষদের সংখ্যাই অনেক বেশি, তাই তাদেরকে টিকা কর্মসূচির আওতায় আনা না গেলে এর সুফল পাওয়া যাবেনা বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ব্রাহ্মনবাড়িয়ার বাসিন্দা পারুল বেগমের বয়স চল্লিশ ছাড়িয়েছে। তার স্বামীর বয়সও পঞ্চাশের কোঠায়। বয়সের হিসেবে তাদের দু’জনেরই করোনাভাইরাসের টিকা পাওয়ার কথা। শুরুতে এই টিকাকে ঘিরে নানা ভ্রান্ত ধারণা থাকলেও পরবর্তীতে গণমাধ্যমে নানা খবর দেখে সেটা দূর হয়।
প্রতিদিন কাজে বের হওয়ার কারণে তারা দুজনেই এখন টিকা নিয়ে নিরাপদ থাকতে চাইছেন, কিন্তু এখন তারা পড়েছেন অন্যরকম জটিলতায়।
কিভাবে টিকা নেবেন, কোথায় যাবেন, টিকা দিতে যে নিবন্ধনের প্রয়োজন হয় সেটা কিভাবে করবেন সে সংক্রান্ত কোনো ধারণাই নেই পারুল বেগমের। তাদের নেই কোনো স্মার্টফোন। পড়াশোনা না থাকায় অন্যের মোবাইল থেকেও নিবন্ধন করতে পারছেন না।
পারুল বেগম বলেন, “কই গেলে টিকা দেয় ইতা চিনি না, কিভাবে দিমু বুঝি না, যদি শুনতাম আমার বাসার পাশে টিকা দিতাসে, তাইলে টিকা দিয়াইতাম, এমনে আমার সুবিধা হইতো। এখন আমি তো মোবাইলের মাধ্যমে কেমনে রেজিস্ট্রেশন করে বা কেমনে কিতা করে এটা আমি বুঝতাম পারি না। আমরার তো স্মার্ট মুবাইল নাই, আমরার তো বাটন মুবাইল। এরলাইগাই তো পারি না।”
বাংলাদেশে গত জানুয়ারি মাসে কোভিড-১৯-এর টিকা আসার পর মানুষের মনে টিকার কার্যকারিতা ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিয়ে নানা সন্দেহ ছিল। তবে ৭ই ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী টিকা কর্মসূচি শুরুর দিন দেশের শীর্ষ রাজনীতিকরা টিকা দেয়ায় মানুষের মনে অনেকটাই আস্থা ফিরতে থাকে।
পরের কয়েক দিন টিকাকেন্দ্রগুলোয় মানুষের উপচে পড়া ভিড় সেটারই ইঙ্গিত দেয়। গত দুই সপ্তাহে সাড়ে ১৮ লাখ মানুষ টিকা দিয়েছে এবং এ পর্যন্ত ৩১ লাখ ৩৭ হাজার মানুষ টিকার জন্য নিবন্ধন করেছে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে।
কিন্তু কেন্দ্রগুলোয় যারা ভিড় করছেন তাদের একটি বড় অংশই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর। স্বল্পশিক্ষিত, সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র শ্রেণীর কাউকেই তেমন দেখা যায়নি।
এই শ্রেণীর মানুষগুলোকে টিকা কর্মসূচির আওতায় আনা একা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষে সম্ভব না।
এজন্য বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবকদের এগিয়ে আসতে হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা।
তিনি বলেন, “টিকা দিতে আমরা কোন শ্রেণী বৈষম্য করছি না। তবে একটাই বিষয় যে টিকা দিতে হলে নিবন্ধন করতেই হবে। সেক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর নিবন্ধনে সহায়তা করতে স্বেচ্ছাসেবক, দাতাসংস্থাগুলোর কর্মী, জন প্রতিনিধি এগিয়ে আসতে পারে। এক স্বাস্থ্যবিভাগের পক্ষে তো সব সম্ভব না।”
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মোকাবিলার সবচেয়ে কার্যকর ও বাস্তবসম্মত উপায় হিসেবে টিকাদান কর্মসূচিকে বিবেচনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে দেয়া হচ্ছে ব্রিটেনের অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা।
যেটা ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট উৎপাদন করে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে। সেখান থেকে জুন মাসের মধ্যে মোট তিন কোটি ডোজ টিকা আসার কথা।
বিশ্বের আরো কয়েকটি উৎস থেকেও ভ্যাকসিন আনার কথা রয়েছে। সব মিলিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিকল্পনা মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষকে এই টিকা কর্মসূচির আওতায় আনা।
যদি প্রান্তিক মানুষ এই টিকাদান কর্মসূচির আওতায় না আসে তাহলে এর সফলতা পাওয়া যাবে না বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মোস্তাক আহমেদ।
তিনি বলেন, “আমাদের দেশে নিম্নআয়ের মানুষের সংখ্যাই বেশি, আমরা যদি দেশের ভাসমান মানুষদের, দুর্গম চরাঞ্চল, পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষদের টিকা কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করতে না পারি, তাহলে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না।”
এক্ষেত্রে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন আহমেদ। তার মতে, মানুষ যেন ঘরের কাছেই টিকা দিতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
এজন্য প্রতিটি শহর এবং গ্রামের ওয়ার্ড কাউন্সিলে একটা করে নিবন্ধন বুথ খোলার প্রয়োজন। যেখানে স্বেচ্ছাসেবকরা নিবন্ধন করতে সাধারণ মানুষকে সাহায্য করতে পারে।
টিকার ব্যাপারে ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে এবং মানুষকে আগ্রহী করে তুলতে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।
এজন্য বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করে, মসজিদের মাধ্যমে, জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে প্রচারণা চালাতে হবে যেন তৃণমূল পর্যায়ের প্রতিটি মানুষ টিকা কর্মসূচির আওতায় আসতে পারে।
সরকারের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সম্মুখ সারির ১৫ ক্যাটাগরির পেশাজীবী এবং যাদের বয়স ৪০ বা তার চেয়ে বেশি তাদের টিকা কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
দেশের মোট জনসংখ্যা ১% এরিমধ্যে টিকা দিয়েছে, ২% নিবন্ধ করেছে বলে আইইডিসিআর জানিয়েছে। প্রথম ধাপে ৩৫ লাখ মানুষকে দুই ডোজ টিকা দেয়ার কথা বলা হলেও এখন জুন মাসের আগেই ৬০ লাখ মানুষকে দেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
সূত্র : বিবিসি