আবেগ যেন দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন না করে

0

আর একদিন বাদেই শুরু হচ্ছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশসহ বিশ্বের তাবৎ বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর জন্য এক গৌরবোজ্জ্বল দিন। বাংলাদেশে দিনটি একাধারে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। ভাষার অধিকার আদায়ে যেসব জাতি রক্ত দিয়েছে তার অগ্রভাগে রয়েছে বাঙালি জাতি। যখন ভাষা আন্দোলন হয় তখন আমি স্কুলের ছাত্র। তৎকালীন সিরাজগঞ্জ মহকুমা এই উপমহাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় ভাষা আন্দোলনের ঢেউ সেখানেও লাগে। এই আন্দোলন আমার মতো স্কুলপড়ুয়া ছাত্রদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। ভাষা আন্দোলন মনে গভীর দাগ কাটার কারণ ছিল, আমি বুঝেছিলাম আমরা ভাষার অধিকার হারিয়ে ফেললে সরকারি চাকরি-বাকরিতে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হবো। তাই ভাষার দাবি আদায় করতে হবে। ভাষার দাবিতে আমার এলাকায় মিছিলে লাঠি হাতে শরিক হয়েছি।

ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন আমাদের মহকুমারই ছিলেন। তখন তিনি ‘ভাষা মতিন’ হিসেবে এলাকায় পরিচিত ছিলেন। ১৯৫৩ সালে যখন যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলো তখন আমি কলেজে পড়ি, মোটামুটি বুঝতে শিখেছি। তখন কলেজে ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িত হই। বুঝতে পারি, পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন মেনে নেয়া যাবে না। তারা আমাদের শোষণ করছে। একসময় সিরাজগঞ্জ মহকুমায় ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলাম। তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন আবদুল মতিন। ছাত্র হিসেবে মোটামুটি ভালোই ছিলাম। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় ৬ নম্বরের জন্য গোটা পূর্ব পাকিস্তানে ফার্স্ট হতে পারিনি। তখন সিরাজগঞ্জ মহকুমায় একটি মাত্র কলেজ- সিরাজগঞ্জ কলেজ। আবদুল মতিনের সাথে আমার একরকম পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। তিনি ছিলেন আমার বড় ভাইয়ের মতো। তার ভাই আমার ছাত্র ছিল। ফলে তার সাথে আমার অনেক কথা হতো। ভাষা আন্দোলনের অনেক কথা তার কাছে শুনেছি। একটি জাতির ভাষা পরিবর্তন করলে সেই জাতি যে মূর্খ হয়ে যাবে সেটা আমি বুঝেছিলাম। একটি জাতিকে পেছনে ঠেলে দিতে চাইলে তার ভাষা বদলে ফেলতে হয়। তাছাড়া, সে সময় বাংলা ভাষাভাষী সমজাতিক জনগোষ্ঠী এই উপমহাদেশে কমই ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে সেটা ছিল না। সেখানে নানা ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠীর বাস। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকায় বসে কেউ একজন বাংলায় কথা বললে সেটা দেশের প্রত্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের পক্ষেও বুঝতে না পারার কারণ ছিল না। এটা এক বিরাট শক্তি। এই শক্তিই পরবর্তীতে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পথ সুগম করে দেয়।

মোগল আমলে এই অঞ্চলে রাজকার্যের জন্য ফার্সি ও আরবি ভাষার প্রভাব ছিল। ইংরেজরা আসার পর সেই জায়গা দখল করে ইংরেজি। পাকিস্তান হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা আমাদের ওপর উর্দু চাপিয়ে দিতে চায়। পূর্ব পাকিস্তান যেন তাদের কলোনি। তাদের এই ঔপনিবেশিক প্রভুসুলভ মনোভাব এ দেশের মানুষ মেনে নিতে পারেনি। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে এ দেশের মানুষও সংগ্রাম করেছে। এর নেতৃত্ব দিয়েছে মুসলিম লীগ। এই দলটিকে আমরা লালন করেছি। আমরা এর বিস্তার ঘটিয়েছি। এর দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য আমাদের বাবা-চাচারা জীবন দিয়েছেন। এর পেছনে একটিই চেতনা ছিল-আমাদের আত্মসত্তা। কিন্তু এই আত্মসত্তার ওপর যখন আঘাত এলো সেই মুসলিম লীগকে এ দেশের মানুষ এমনভাবে ছুড়ে ফেলল যে দলটিকে অস্তিত্বহীন করে ছাড়ল।

অথচ এই ঢাকাতেই ১৯০৬ সালে দলটির জন্ম, এর প্রতিষ্ঠাতা নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ এই মাটিরই সন্তান। আব্বা বলতেন, ‘তোরা তো জানিস না, আমরা কেন মুসলিম লীগ সমর্থন করি। মুসলিম লীগ না হলে এই দেশটিই হতো না। আমার আব্বার কাছে শুনেছি, কিভাবে রবীন্দ্রনাথসহ বিশেষ করে হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিলেন। বাংলা ভাষাকে সর্বভারতীয় ভাষাগুলোর মধ্যে তারা স্থান দিতে চাননি।

ভারতীয় কংগ্রেস নেতা মহাত্মা গান্ধী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন : ভারত স্বরাজ লাভ করলে তার সাধারণ ভাষা কী হবে? রবীন্দ্রনাথ জবাবে বলেন : হিন্দি। অন্যদিকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বক্তব্য ছিল, বাংলা, উর্দু ও হিন্দি এই তিনটি ভাষারই যোগ্যতা রয়েছে রাষ্ট্রভাষা হবার।

ভাষা আন্দোলন ছিল একই সাথে রাজনৈতিক, অধিকার আদায়ের ও আত্মসত্তার আন্দোলন। মাতৃভাষার প্রতি আমার দরদ আছে প্রধানত মায়ের ভাষা হওয়ার জন্য। কিন্তু এর মানে এই নয় যে মাতৃভাষা শিখতে গিয়ে আমরা অন্য ভাষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবো এবং আর কোনো ভাষা শিখব না। আরেক মা হিন্দিতে কথা বলে। আরেক মা তো ইংরেজিতে, আরবিতে বা ফার্সিতে কথা বলে। সবাই যে মা। তাহলে মাতৃভাষাকে ভালোবাসলে অন্য মায়ের ভাষাকে কেন আমি অশ্রদ্ধা করব, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করব? তাহলে আরেক মায়ের ভাষা শেখা কেন অন্যায় হবে?

আমরা যদি আবেগের বশে নিজের মায়ের ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা শেখা বাদ দেই, সেটা জাতিকে অশিক্ষিত করার আরেক কারণ হবে। মাতৃভাষার প্রতি দরদ যেন অন্য ভাষার প্রতি ঘৃণার বিষয়ে পরিণত না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। অন্য ভাষা না শিখলে আজকের বৈশ্বিক গ্রামে কূটনৈতিক মিথস্ক্রিয়া, অর্থনৈতিক মিথস্ক্রিয়া- এগুলো সম্ভব নয়। আবার বছরের শুধু একটি মাসেই আমরা বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসায় গদগদ হবো আর বাকি সময়ে ওই ভালোবাসা থাকবে না, সেটাও কাম্য নয়।

নিজের জীবনেই দেখেছি, ৩৩ বছর দেশের বাইরে ছিলাম, সৌদি আরবেই ১৮ বছর কাজ করেছি অথচ আমি আরবি জানি না। পাপুয়া নিউগিনির বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছি অথচ সে দেশের ভাষা জানি না। আমি তুরস্কে কাজ করেছি অথচ সে দেশের ভাষা শিখিনি। সরকারি চাকরির কারণে পশ্চিম পাকিস্তানে আমাকে যেতে হয়েছিল। তখন কর্মকর্তাদের জন্য পাকিস্তানের দুই অংশের ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক ছিল। আমাকে উর্দুভাষা শিখতে হয়েছিল। সারা বিশ্ব ঘুরে ঘুরে চাকরি করতে পেরেছিলাম কারণ আমার ইংরেজি ভাষাটি শেখা হয়েছিল। তাই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রাক্কালে আমার আবেদন থাকবে, কোনো ভাষার প্রতিই যেন আমরা অশ্রদ্ধা না দেখাই এবং আন্তর্জাতিক ভাষা শেখার ব্যাপারেও যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করি। আমাদের অনেক রাজনীতিককে দেখি, আবেগের বশে আরেক মায়ের ভাষাকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেন। এমন রাজনীতিকের অনুসারী হলে আমার মতো নগণ্য মানুষের হয়তো পিএইচডি করা হতো না। বাংলার পাশাপাশি মাত্র একটি আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি শিখতে পারার কারণেই আমি আরবি ভাষাভাষীদের নিয়ে কাজ করতে পেরেছি।

যারা জ্ঞানচর্চা করেন তারা অন্তত এক্ষেত্রে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সমাজকে দিকনির্দেশনা দিন। ওয়াশিংটন বা দিল্লি এসে আমাদের কোনো কিছু করতে বললে অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে আমরা অসহায় হয়ে পড়ি। কিন্তু কোনোভাবেই বিশ্বাস করি না যে, আমরা দুর্বল। ১৭ কোটি মানুষ একই ভাষায় কথা বলে- এমন কয়টি দেশ পৃথিবীতে আছে? বাংলাদেশে জনগণ হোমোজিনিয়াস। প্রতিবেশী ভারতে আমরা দেখি, যখন হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা ওঠে তখন বিভিন্ন রাজ্য থেকে প্রবল বিরোধিতা শুরু হয়ে যায়। আমাদের ভাষা আমাদের নিজস্ব শক্তি।

এক্ষেত্রে আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগের কথা বলছি। ২০০৬ সালের দিকে আমার জেলা সিরাজগঞ্জের নিমগাছিতে একটি ইংলিশ মিডিয়াম প্রাইমারি স্কুল স্থাপন করি। এটি ছিল ‘হাউজ অব মান্নান দাতব্য ট্রাস্ট’ পরিচালিত। স্থানটি বেশ প্রত্যন্ত এবং আশপাশে খুব বেশি সচ্ছল পরিবারের বসবাস নেই। আমার লক্ষ্যই ছিল স্থানীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে যদি কিছুটা উন্নত শিক্ষা দেয়া যায়। প্রথম ব্যাচে ১৬ জনের মতো শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। তখন তাদের অভিভাবকরা আমার কাছে আসেন। আমাকে বলা হয়, প্রাইমারি লেভেলে ইংরেজি পড়ানো নিষিদ্ধ। তারা আমার কাছে জানতে চান, তাহলে এই স্কুলে যারা পড়াশুনা করবে তাদের ভবিষ্যৎ কী? তখন আমি তাদেরকে আশ্বস্ত করি যে, সরকার শিগগিরই এর গুরুত্ব উপলব্ধি করবে এবং নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে।

এরপরও যদি অনুমতি না-দেয় তাহলে আমি এসব শিক্ষার্থীকে ব্রিটিশ সিস্টেমে ও লেভেল, এ লেভেল পড়ানোর ব্যবস্থা করব। পুরো বিষয়টি বুঝিয়ে বলার পর তারা শান্ত হলেন। মজার বিষয় হলো, এর পরের বছরেই (জরুরি অবস্থার) সরকার দেশে প্রাইমারি লেভেলে ইংরেজি জোরদার করার উদ্যোগ নেয়। আমিও তখন সরকারি অনুমতি লাভ করি। আমার মনে হয়, আরো আগেই এই অনুমতি দেয়ার দরকার ছিল। শিক্ষাকে ব্যবসা ও রাজনীতির সাথে জড়িত করাটা জাতির জন্য কত ক্ষতিকর হয়েছে তা আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জাতীয় পার্টি- কোনো সরকারই বুঝেনি। স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা ভাষা নিয়ে টানাহেঁচড়া করছি।

কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক ইকোনমিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের দায়িত্বে ছিলাম। এই সুবাদে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা আমার কাছে আসতেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে তাদের অনেকে আমার সাথে বাংলায় কথা বলা শুরু করে দিতেন। ইংরেজি তো ছিল সাধারণ ভাষা। সে জার্মানই হোক বা নাইজেরিয়ান। আমি অবাক হতাম। এর মানে হলো যাকে আমার কাছে পাঠানো হতো তাকে সে জন্য প্রস্তুত করা হতো।

তাই আমি মনে করি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া প্রতিটি শিক্ষার্থী বাংলার পাশাপাশি অন্তত আরেকটি ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক করা উচিত। এটি এমন ভাষা হবে যা দিয়ে দেশের বাইরেও বিচরণ করতে পারে যে ভাষা তার জীবনের উন্নয়নের জন্য সহায়ক হবে। ভাষা শেখার প্রবণতাকে খর্ব করা যাবে না। বিশেষ করে জাতিসঙ্ঘের দাফতরিক ভাষা যেমন, ইংরেজি, আরবি, চীনা, ফরাসি, ইত্যাদি শেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আমি মনে করি শুধু ভাষা শেখানোর জন্য দেশে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া উচিত। যুগের সাথে চলতে হলে আমাদের আবেগপ্রবণতাকে দমন করতে হবে। দেশের শিক্ষার মান নিয়ে আমার আক্ষেপের শেষ নেই। এখানকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডির স্বীকৃতি কতটা আছে বাইরের বিশ্বে? আমাদের মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ডিগ্রিগুলোর স্বীকৃতি বিশ্বে কতটা? আন্তর্জাতিক ভাষা শিক্ষা এই অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারে।

মাতৃভাষা বলতে শুধু বাংলাভাষাকে বুঝাব না। মাতৃভাষা মানে, মায়ের ভাষা। আমার মায়ের ভাষা বাংলা। আমার মা বাংলায় কথা বলে। পাশের বাড়ির যে লোকটি আছে তার মা হিন্দিতে কথা বলে। আমার মাকে যদি শ্রদ্ধা করি তবে অন্যের মাকেও শ্রদ্ধা করতে হবে। অন্যের মাকে শ্রদ্ধা করলে তার ভাষাকেও শ্রদ্ধা করতে হবে। অন্যের মায়ের সাথে কথা বলতে হলে ওই মায়ের ভাষা শিখতে হবে। বাংলা ভাষার প্রতি অতি আবেগ আমাদেরকে যেন সারা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে না ফেলে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com