রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কারও দৃষ্টিভঙ্গি কি বদলেছে
প্রায় এক বছর আগে আন্তর্জাতিক আদালত মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত সহিংসতা ও বৈষম্যের নীতির তথ্যগুলো ‘বিশ্বাসযোগ্য’ হিসেবে সিদ্ধান্ত টেনেছিলেন। আদালত দেশটির অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য গণহত্যার ঝুঁকি থেকে তাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য একটি অন্তর্বর্তী আদেশও জারি করেছিলেন। ওই আদেশ বাস্তবায়নে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে, তা আদালতকে নিয়মিত বিরতিতে জানানোর নির্দেশনাও তাতে আছে। আন্তর্জাতিক পরিসরের এই বিচারব্যবস্থা জটিল এবং সময়সাপেক্ষ হওয়ায় মানুষের ধৈর্যচ্যুতিও ঘটে। তবে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে সদ্য অনুষ্ঠিত ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ, ইউপিআর ব্যবস্থায় মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতির তৃতীয় পর্যালোচনায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের মনোভাবের যে প্রতিফলন দেখা গেছে, তার আলাদা কোনো তাৎপর্য আছে কি না, ভেবে দেখা দরকার।
তিন বছর আগে, ২০১৭ এর ৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর রাষ্ট্রীয় সহিংসতার কঠোর নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে তা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছিল। একই সঙ্গে, পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবটিতে রোহিঙ্গা মুসলমান জনগোষ্ঠী ছাড়াও অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর সবার সুরক্ষা ও মৌলিক মানবাধিকারসমূহ নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছিল। এরপর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এবং সাধারণ পরিষদেও বিষয়টি নিয়ে কয়েকবার আলোচনা হয়েছে। সাধারণ পরিষদে অন্তত তিনবার প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে ভোটাভুটি হয়েছে। সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে মিয়ানমারের জাতিগত সহিংসতার নিন্দা ও বিচারের প্রস্তাবে চীন ও রাশিয়া বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। ভোটদানে বিরত থেকেছে যেসব দেশ তার মধ্যে আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারত, জাপানসহ কয়েকটি পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশ রয়েছে।
গত সোমবার জেনেভায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ, ইউপিআর ব্যবস্থায় মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতির পর্যালোচনায় ১১২টি দেশের প্রতিনিধিদের অধিকাংশই এবার দুটি বিষয়ের প্রতি জোর দিয়েছেন। একটি হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতির জন্য অত্যাবশ্যক জাতিগত বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন। এই নাগরিকত্বের প্রশ্ন সুরাহার জন্য কফি আনানের নেতৃত্বাধীন রাখাইন পরামর্শক বা অ্যাডভাইজরি কমিশনের সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়ন এবং ওই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
আর, অপরটি আন্তর্জাতিক আদালতের অন্তর্বর্তী নির্দেশনা প্রতিপালন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর ঘটনাগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো গ্রহণের আহ্বান। এসব পদক্ষেপের মধ্যে সুস্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক তদন্তকারীদের রাখাইনে যেতে দেওয়ার কথা যেমন আছে, তেমনই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সঙ্গে সহযোগিতার আহ্বানও আছে। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর পরিচালিত নিরাপত্তা অভিযানে গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার অভিযোগ ওঠার পর জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থায় এটিই প্রথম দেশটির সর্বজনীন মানবাধিকার পরিস্থিতির পর্যালোচনা বা ইউপিআর।
বাংলাদেশও জাতিসংঘের কোনো ফোরামে এই প্রথমবারের মতো স্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিজে) এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করার জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানাল। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক তদন্তকারী এবং স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ারকেও অবাধ প্রবেশাধিকার দেওয়ার কথা বলেছে। আন্তর্জাতিক আদালতে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলায় বাংলাদেশ শুরু থেকে সহযোগিতা দিয়ে এসেছে ঠিকই, তবে তা ততটা খোলাসা করে নয়। ওই মামলায় পক্ষভুক্ত হওয়ার আহ্বানে বাংলাদেশ সাড়া দেয়নি। এবারই এ বিষয়ে অবস্থান এতটা খোলাসা হলো। তবে এ কথাও এখন অন্য সবাইকে বলা জরুরি যে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নির্মূলকরণের নিন্দা ও বিচারকে সমর্থন না করা মানবতাবিরোধী অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়ারই শামিল। কানাডা ও নেদারল্যান্ডস আইসিজের মামলায় পক্ষভুক্ত হওয়ার আবেদন করার কথা জানিয়েছে। আর যুক্তরাজ্যও মামলায় সহায়তা দেওয়ার কথা বলেছে। এসব কারণে যৌক্তিকভাবেই ধারণা করা চলে যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমার থেকে নির্মূল করার অভিযানের জবাবদিহি আদায়ে আন্তর্জাতিক আদালতের প্রাথমিক সাফল্য অন্যান্য দেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা দেওয়া এবং প্রত্যাবাসনেই বিশ্ব সম্প্রদায়ের লক্ষ্য সীমাবদ্ধ নয়। প্রত্যাবাসনের অগ্রাধিকার ক্ষুণ্ন হোক, সেটা কারও কাম্য নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এ বিষয়ে ২০১৭ এর ২৩ নভেম্বরে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই করার পর তিন বছরে একজনেরও প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়নি। শুরু থেকেই চীন, রাশিয়া ও ভারত রোহিঙ্গা সংকটকে দ্বিপক্ষীয় বিরোধ এবং একটি মানবিক সমস্যা হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে এসেছে। তারা এখনো দ্বিপক্ষীয় আলোচনাতেই শরণার্থী সমস্যার সমাধানের কথাই বলে চলেছেন। চীনের মধ্যস্থতার ভূমিকার কথাও নতুন নয়। তবে সেই ত্রিপক্ষীয় আলোচনা আয়োজনে সময় লেগেছে তিন বছর।
নাগরিকত্বের স্বীকৃতির প্রশ্ন মীমাংসা ছাড়া প্রত্যাবাসন প্রশ্নে কোনো মধ্যস্থতা কাজে আসবে এমন আশাবাদের যে কোনো ভিত্তি নেই, তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। মিয়ানমার চার দশক ধরে রোহিঙ্গাদের বাঙালি আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার ধারাবাহিক চেষ্টা চালিয়ে আসছে। বাংলাদেশ তাই রাখাইন কমিশনের সুপারিশমালা পুরোপুরি বাস্তবায়নের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি লাভের যে সুস্পষ্ট ব্যবস্থার কথা জেনেভায় বলেছে, তা অর্জনেও আন্তর্জাতিক আদালতের অন্তর্বর্তী আদেশ প্রতিপালনের ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। কেননা, ওই আদেশেই সিদ্ধান্ত টানা হয়েছে যে মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা সুরক্ষা লাভের অধিকারী একটি জাতিগোষ্ঠী। আদালত তাঁর সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২০১৯ সালের ২৭ ডিসেম্বরের গৃহীত প্রস্তাবের একটি অংশ উদ্ধৃত করেছেন। প্রস্তাবের ওই অংশটুকু ভাষান্তর করলে দাঁড়ায়: মিয়ানমারের স্বাধীনতার আগে থেকে বহু প্রজন্ম ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানরা সেখানে বসবাস করে আসছে, সেটি সত্য হলেও ১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব আইন তৈরির মাধ্যমে তাদের রাষ্ট্রহীন করে ফেলা হয়েছে এবং শেষতক ২০১৫ সালে তাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে বাদ দিতে ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে।
মিয়ানমার মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপের বিবরণ তুলে ধরলেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের প্রশ্ন কিংবা আন্তর্জাতিক আদালতের বিচার প্রক্রিয়ার বিষয়ে সরাসরি কোনো অঙ্গীকার বা উদ্যোগের কথা বলেনি। তবে দেশটি আদালতের অন্তর্বর্তী
নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতির বিষয়ে সময়মতো প্রতিবেদন পেশ করেছে। আদালতের নির্দেশনা মানার বিষয়ে কতটা সততা অথবা চাতুরীর আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে তা অবশ্য জানার কোনো উপায় নেই। কেননা, আদালত তা প্রকাশ করেননি। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে এগুলো প্রকাশ করার দাবি উঠেছে, যাতে তার সত্যাসত্য যাচাই সম্ভব হয়। পাশাপাশি, আলাদাভাবে আইসিসির তদন্তও অব্যাহত আছে। আইনগত এসব প্রক্রিয়া যতই ত্বরান্বিত হবে, মিয়ানমার যে ততই সমাধানের চাপ অনুভব করবে, সে রকমই আভাস মেলে।