হীনম্মন্যতার কারণেই স্ত্রীকে সন্দেহের চোখে দেখেন স্বামী
সামাজিক জীব হওয়ায় আমরা, মানুষেরা এক সাথে সুন্দর জীবনযাপনের জন্য নানা সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলি। এর মধ্যে পরিবার একটি। পরিবারকে বলা হয় সমাজের আদিমতম প্রতিষ্ঠান। পরিবার গঠনে সমাজে সর্বজন স্বীকৃতি প্রক্রিয়া হলো ‘বিয়ে’। এ কারণে বিয়েও একটি আদি ও অকৃত্রিম সামাজিক প্রথা। বিয়ে এমনই এক ব্যবস্থা যার মাধ্যমে দু’জন বিপরীত লিঙ্গের মানুষ সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে একসাথে বসবাস এবং পারিবারিক কাজকর্ম সম্পাদনের অনুমোদন তথা যোগ্যতা লাভ করে। বিয়ে এমন একটি চুক্তি, যা মূলত দুজন নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পাদিত হলেও তা দু’টি ভিন্ন পরিবার তথা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোকেও প্রভাবিত করে। খুব স্বাভাবিকভাবেই তাই বিয়ের অপরিসীম গুরুত্ব স্বীকার করে নিতে হয়। কিন্তু বিয়েও প্রয়োজনে বিচ্ছেদযোগ্য। মানুষের প্রয়োজনেই সমাজ, সমাজের প্রয়োজনে মানুষের মূল্যকে অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। তাই বিশেষ অবস্থায় বিচ্ছেদ আবশ্যক হলে সামাজিকতার যূপকাষ্ঠে নিজেকে বলি না দিয়ে সম্মানজনক সমাধানস্বরূপ বিচ্ছেদ গ্রহণযোগ্য। সেজন্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বিয়ে বিচ্ছেদের অনুমোদন দেয়া হয়। তবে বর্তমানে বিয়ে বিচ্ছেদ যেন এক সামাজিক ব্যাধির রূপ নিয়েছে। পরিসংখ্যানে প্রকাশ, সম্প্রতি কোভিড-১৯ এর কারণে ‘নিউ নরমাল’ পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে বিয়ে বিচ্ছেদ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। বিশেষ করে, শহরাঞ্চলে এ হার ভয়াবহ।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমাদের সামনে সমাজে বিয়ে বিচ্ছেদের প্রয়োজনীয়তা, প্রাসঙ্গিকতা এবং এর প্রভাব নিয়ে নতুন করে ভাবা জরুরি হয়ে পড়েছে। বিয়ে একটি দেওয়ানি চুক্তি। এর সামাজিক, ধর্মীয় ও আইনগত স্বীকৃতি রয়েছে। মূলত বিধিবদ্ধ সুস্থ জীবনের একটি পদক্ষেপ এই বিয়েপ্রথা। বলা যায়, পোষাকের আবিষ্কার যেমন মানুষের সভ্যতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার একটি মাইলফলক, বিয়েও তেমনি। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, সনাতন হিন্দু ধর্মে পৌরাণিক কাল থেকেই বিয়েকে দু’জন মানুষের জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধন হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। সেই সাথে একে অবিচ্ছেদ্য বলে অভিহিত করা হয়েছে। খ্রিষ্টধর্মেও ধর্মীয়ভাবে বিয়ে বিচ্ছেদের কোনো বিধান নেই। শুধু ইসলামেই শর্ত সাপেক্ষে বিয়ে বিচ্ছেদের স্বীকৃতি রয়েছে। তবে মুসলিম সমাজে প্রচলিত মত, যাবতীয় হালাল (অনুমোদিত) কাজের মধ্যে এটি সর্বাধিক অপছন্দনীয় কাজ।
নানাবিধ কারণে বিয়ের বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসে মানুষ। অতি সম্প্রতি আমাদের দেশে বিয়ে বিচ্ছেদের জন্য যেসব কারণ দেখা যাচ্ছে, সেগুলো হলো- যৌতুক, পরকীয়া, বন্ধ্যাত্ব, মাদকাসক্তি, শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কুপ্রভাব, পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ ইত্যাদি। এসব কারণের মধ্যে দুয়েকটি বাদে বাকিগুলো প্রায় সবই নৈতিক অবক্ষয়ের বিষফল। এ ছাড়া বিয়েবিচ্ছেদের পর বিচ্ছিন্ন দম্পতির সন্তান এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের ওপরেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা থেকে অনেক ধরনের সামাজিক, পারিবারিক ও নৈতিক সঙ্কটের জন্ম হতে পারে।
বিয়ে বিচ্ছেদের কারণগুলো যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে দেখা যায়, যৌতুক একটি ঘৃণিত সামাজিক প্রথা, এর কারণে বহু মেয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। এই নির্যাতন থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে বিয়ে বিচ্ছেদকেই অনেকে বেছে নেন। কিন্তু যৌতুকের মতো এই কুপ্রথা কিছু মানুষের মাত্রাতিরিক্ত লোভ ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে মাদকাসক্তিও বিয়ে-বিচ্ছেদের বিশেষ কারণ হিসেবে দেখা গিয়েছে। বর্তমান জামানার ছেলে-মেয়ে উভয়ের মধ্যেই আশঙ্কাজনক হারে এই আসক্তি বেড়ে যাওয়ায় বহু সংসার ভেঙে যাচ্ছে। একই সাথে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরিক্ত আসক্তিতে অনেকে জড়িয়ে পড়ছেন বিয়েবহির্ভূত অনৈতিক সম্পর্কে, যার চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে বিয়ে-বিচ্ছেদ। একইভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা অন্যদের বিলাসী জীবন অনেককে অহেতুক প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দেয়। বা অন্যের জীবনের চাকচিক্য দেখে নিজেকে অসুখী ভাবার প্রবণতা তৈরি হয়। ফলে মানুষ নানামুখী অপকর্ম বা অনৈতিক উপার্জনের পথে অগ্রসর হয়। আর তাতেও যদি তৃপ্ত না হন; তাহলে অনেকে বিয়েবিচ্ছেদকে সমাধান মনে করে থাকেন।
বিয়েবিচ্ছেদের অন্যতম কারণ হিসেবে অনেকেই নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি উল্লেখ করে থাকেন। কিন্তু আসলেই কি তাই? বর্তমানে নারীশিক্ষার বিস্তারসহ নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়ে যাওয়ায় মেয়েরা অনেকাংশে অর্থনৈতিক মুক্তি পেয়েছে। বহু পরিবারেই স্বামী এ বিষয়ে ইতিবাচক হলেও অনেক পুরুষ এতে হীনম্মন্যতায় ভোগেন। অথবা স্ত্রীকে সন্দেহের চোখে দেখেন। এটা পুরুষের বহু দিনের লালিত কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের ফল। যাকে আমরা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা বলি। যার করুণ পরিণতি বিয়ে বিচ্ছেদে গিয়ে পৌঁছে। কিন্তু পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের মাধ্যমে খুব সহজেই এ সঙ্কট এড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি পাশ্চাত্যের প্রভাবে ইদানীং অনেক তরুণ-তরুণীই বিয়ে-বহির্ভূত একত্র বাস বা ‘লিভ টুগেদার’ করাকে বেশি উপভোগ্য মনে করছেন। কিন্তু দায়িত্বহীন এমন সম্পর্ক আমাদের দেশের প্রক্ষাপটে কোনো সুস্থ ব্যবস্থা নয় বলে প্রতীয়মান হয়। এ জন্য একটি স্বাভাবিক বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গঠিত পরিবারের কোনো বিকল্প নেই বলেই আমরা মনে করি। সম্প্রতি ঢাকায় এক দম্পতি বিয়েবিচ্ছেদের পর তাদের একমাত্র শিশুসন্তানের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন। মা-বাবা কেউই শিশুটির দায়িত্ব না নেয়ায় শেষ পর্যন্ত বিষয়টি আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়! আদরের আর সাধনার ফসল একটি সন্তান নিয়ে এমন হেনস্থা আমাদের সামনে বিয়ে বিচ্ছেদের কুফলকেই যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এ ছাড়া মা-বাবার বিয়েবিচ্ছেদে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সন্তানের মনোজগতে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়। তাই তারা অনেকেই বিপথগামী হয়ে মাদকাসক্তিসহ নানা অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ে। যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খুবই আশঙ্কাজনক।
সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি নির্মূল করতে প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তার বিখ্যাত রিপাবলিক গ্রন্থে পরিবারহীন সমাজব্যবস্থার কথা চিন্তা করলেও তা একটি ইউটোপিয়া তথা কল্পনাই থেকে গেছে। কারণ পরিবার সামাজিক একক হিসেবে মানুষের নৈতিক শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্র। সেই কারণে পরিবারকে অস্বীকার করে বা বিয়েবিচ্ছেদের মাধ্যমে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন করা অনেকটাই কঠিন। মোট কথা একটি পরিবার তথা সুস্থ সামাজিক জীবন গড়ে তুলতে পারস্পরিক সম্মানবোধ, ভালোবাসা সর্বোপরি নৈতিক চর্চা আবশ্যক, এ জন্য বিয়ে বিচ্ছেদ কোনো সুস্থ সমাধান নয়। বরং বলা চলে, অধিক বিয়েবিচ্ছেদ সর্বাংশেই একটি সমাজে বিপর্যয় বয়ে নিয়ে আসে।
লেখক : জিনান বিনতে জামান সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, ঢাকা কলেজ।