শুভংকরের ফাঁকি ‘ম্যাচিং ফান্ড’
এক হাজার ২৫৯ কোটি টাকার ম্যাচিং ফান্ড সংকটে পড়েছে দেশের চার সিটি করপোরেশন। ম্যাচিং ফান্ড সংস্থান করতে না পেরে এসব সিটি করপোরেশনের কোনোটি মাঝপথে থামিয়ে দিয়েছে প্রকল্প; কোনোটি প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার পর ঠিকাদারদের বিল দিতে পারছে না। আবার কোনো কোনো সিটি করপোরেশন ম্যাচিং ফান্ডের অর্থ বাদ দিয়েই ঠিকাদারদের সঙ্গে সমঝোতায় শেষ করছে প্রকল্প। ম্যাচিং ফান্ড খড়্গে ন্যুব্জ ওই সব সিটি করপোরেশনের মেয়ররা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণে অনিচ্ছুক। সম্প্রতি চট্টগ্রাম, রাজশাহী, নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, উন্নয়ন প্রকল্প ব্যয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ বরাদ্দ দেয় সরকার। প্রকল্পভেদে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ সিটি করপোরেশনের নিজস্ব তহবিল থেকে সংগ্রহ করতে বলা হয়, যা ম্যাচিং ফান্ড নামে পরিচিত। কিন্তু কর্মীদের বেতন-ভাতা ও আনুষঙ্গিক খরচ মেটাতে যেখানে সিটি করপোরেশনগুলো ব্যর্থ সেখানে ম্যাচিং ফান্ড সংস্থান দুরূহ হয়ে উঠে তাদের জন্য। ফলে কাজ অসম্পূর্ণ রাখা, দীর্ঘসূত্রতা, অনৈতিক সমঝোতা এবং ঠিকাদারদের বিল না দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে বিভিন্ন সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন প্রকল্পে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৫টি প্রকল্পে ৭১৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকার ম্যাচিং ফান্ড সংকটে রয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। এর মধ্যে নগরের ‘বহদ্দারহাট বারইপাড়া হতে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন প্রকল্পে’ ৩১৪ কোটি চার লাখ টাকা ম্যাচিং ফান্ড ছিল সংস্থাটির। এ ছাড়া ‘চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন রাস্তা এবং ফুটপাত উন্নয়ন ও প্রশস্তকরণ প্রকল্পে ৪৪ কোটি সাত লাখ টাকা, অ্যাসফল্ট প্লান্ট প্রকল্পে ৫০ কোটি এক লাখ, বন্যা ও জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামত প্রকল্পে ১৭৯ কোটি টাকা ম্যাচিং ফান্ড সংকট আছে। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও ব্রিজগুলোর উন্নয়নসহ আধুনিক যান-যন্ত্রপাতি ও সড়ক আলোকায়ন প্রকল্পের ৮৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা ম্যাচিং ফান্ড সংকট রয়েছে। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য নিবাস নির্মাণ প্রকল্পে ৪৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা ম্যাচিং ফান্ড রয়েছে চসিকের।
এ ছাড়া ৪৩৪ কোটি টাকার বেশি ম্যাচিং ফান্ড সংকট আছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি)। নিজস্ব বেতন-ভাতাসংক্রান্ত আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে পারলেও বিভিন্ন প্রকল্পের ম্যাচিং ফান্ড সংকট নিরসন করতে পারছে না সংস্থাটি। কয়েক বছর আগে শেষ হওয়া প্রকল্পের ঠিকাদারদের বিল এখনো পরিশোধ করতে পারেনি ডিএসসিসি। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ডিএসসিসির অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের ৩৬৫ কোটি টাকার ম্যাচিং ফান্ড রয়েছে। এ ছাড়া পাঁচটি অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের আরো ৫২ কোটি টাকা এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও জনসেবা প্রকল্পের ১৭ কোটি টাকার ম্যাচিং ফান্ড আছে বলে জানা গেছে।
জানা যায়, চারটি প্রকল্পে ৭৬ কোটি ১৪ হাজার টাকার ম্যাচিং ফান্ড সংকটে আছে রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক)। এর মধ্যে রাজশাহী-নওগাঁ সড়ক থেকে রাজশাহী-নাটোর সড়ক পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের ম্যাচিং ফান্ড ৯ কোটি ৯ লাখ টাকা। রাজশাহীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণে নর্দমা নির্মাণ প্রকল্পে (তৃতীয় পর্যায়) ছয় কোটি ৮৩ লাখ ৬১ হাজার টাকার ম্যাচিং ফান্ড রয়েছে। এ ছাড়া কল্পনা সিনেমা হল থেকে তালাইমারী মোড় পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পে ম্যাচিং ফান্ড ২৫ কোটি ৪৯ লাখ ৮৬ হাজার এবং রাজশাহীর গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার উন্নয়ন প্রকল্পে ৩৪ কোটি ৫৯ লাখ ৬৭ হাজার টাকার ম্যাচিং ফান্ড রয়েছে।
চসিক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের নিজস্ব আয় সরকার কর্তৃক নির্ধারিত। নিজেদের টাকায় কর্মীদের বেতন-ভাতা দিতেই হিমশিম খেতে হয়। কিন্তু ম্যাচিং ফান্ড আমাদের জন্য একটি বড় বোঝা।’
রাসিক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে প্রকল্পের সব অর্থ দিলে কাজ সুন্দর হয়। ম্যাচিং ফান্ড সংকটের কারণে প্রকল্প নিতেই ভয় হয় আমাদের।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত জুন মাসে শেষ হয়েছে ‘নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প।’ ২০ কোটি টাকার প্রকল্পটিতে সরকার বরাদ্দ দেয় ১৬ কোটি টাকা। বাকি চার কোটি টাকা নাসিকের নিজস্ব তহবিল দেওয়ার কথা। কিন্তু করপোরেশনের তহবিলে কোনো অর্থ না থাকায় ৮০ শতাংশ কাজ শেষ করে প্রকল্পটির কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাকি ২০ শতাংশ কাজ হবে কি না সে ব্যাপারে জানে না সিটি করপোরেশনের কেউ।
নাসিকের রাস্তা ও নর্দমা নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণসংক্রান্ত আরো একটি প্রকল্প আছে। ১৯১ কোটি টাকার এই প্রকল্পটির সংশোধিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২০৭ কোটি টাকা। মোট অর্থের ৭০ শতাংশ জোগান দেওয়ার কথা সরকারের। বাকি ৩০ শতাংশ টাকা নিজস্ব তহবিল থেকে সংস্থান করতে বলা হয়েছিল। চলতি বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ৬২ কোটি এক লাখ টাকার ম্যাচিং ফান্ড সংকটে পড়েছে নাসিক। ৩০ শতাংশ কাজ বাকি রেখেই প্রকল্পটি শেষ করা হতে পারে—এমন আশঙ্কা রয়েছে করপোরেশনের কর্মকর্তাদের।
সংশ্লিষ্ট করপোরেশনগুলোর প্রকৌশল দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ম্যাচিং ফান্ড সংস্থান হবে না—এটা সিটি করপোরেশন জানে। তাই ঠিকাদারদের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতা করেই প্রকল্পের কাজ শেষ করা হয়। ম্যাচিং ফান্ডের অর্থ বাদ দিয়েই কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে কোনো কোনো প্রকল্পের কাজ ভালোভাবে করে বিল না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন ঠিকাদাররা। অবশ্য এ ব্যাপারে কোনো কর্মকর্তা বা ঠিকাদার মুখ খুলতে রাজি হননি। প্রকল্পের কাজে ফাঁকি দেওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন মেয়ররা।