ঢাকার বাতাস আজ সবচেয়ে দূষিত, বিপজ্জনক!
ঢাকার বাতাস আজ স্মরণকালের সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বায়ুমান যাচাইয়ের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়াল একিউআই-এর বায়ুমান সূচক অনুযায়ী, আজ (১০ জানুয়ারি, ২০২১) সকাল ১০.২০ মিনিটের সর্বশেষ তথ্যে জানা যাচ্ছে, ঢাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা হচ্ছে গড়ে ৪৩৯।
এর আগে গত ২১ নভেম্বর ঢাকায় সর্বোচ্চ বায়ুদূষণের মাত্রা ছিল ৩১৫। যেটা দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরীর তালিকায় এক নম্বরে উঠে এসেছিল ঢাকা। সে থেকে ক্রমাগত বায়ুদূষণের মাত্রা শুধু বাড়ছেই। যেটার সর্বশেষ পরিস্থিতি গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫০-এর কাছাকাছি।
এয়ার ভিজ্যুয়ালে’র একিউআই সূচকে দেখা যাচ্ছে, ঢাকার প্রতি ঘণমিটার বাতাসে সুক্ষ ধূলিকনার (পিএম ২.৫) উপস্থিতি পাওয়া গেছে ৩৭৯.৪ মাইক্রোগ্রাম। যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকি বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।
বাতাসে স্বাভাবিক দূষণের মাত্র ৫০ একিউআই। অথচ ঢাকার বাতাস তার চেয়ে ৫ গুণ বেশি দূষিত। ঢাকার মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি দূষিত এলাকা হচ্ছে এখন বারিধারা-আমেরিকান এম্বেসির কাছাকাছি এলাকা। যেখানে বায়ুমান পাওয়া গেছে ৫০০’রও বেশি।
বিশ্ব র্যাংকিংয়ে ঢাকার অবস্থান প্রথম। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা নেপালের কাঠমান্ডুর সূচকের চেয়ে ঢাকার মাত্রা দ্বিগুণেরও বেশি। কাঠমান্ডুর একিউআই মাত্রা হচ্ছে মাত্র ১৯৫। তৃতীয় স্থানে আফগানিস্তানের কাবুল, তাদের বাতাসের মান ১৭৭ একিউআই এবং পাকিস্তানের লাহোরের বাতাসের মানও ১৭৭ একিউআই।
আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, ভারতের রাজধানী শহর দিল্লি এক সময় ছিল বায়ুদূষণে এক নম্বর স্থানে, তাদের অবস্থান এখন ৫ নম্বরে। শহরটির বাতাসে দূষণের পরিমাণ ১৭৫ একিউআই। কলকাতার অবস্থান ৭ নম্বরে। শহরটির বাতাসে দূষের মাত্রা ১৬৯ একিউআই।
এয়ার ভিজুয়্যাল বাতাসের মানকে মোট ৬টি স্কেলে পরিমাপ করে থাকে। এগুলো হচ্ছে- গুড, মডারেট, আনহেলদি ফর সেনসেটিভ গ্রুপস, আনহেলদি, ভেরি আনহেলদি এবং হেজার্ডাস (বিপজ্জনক)। ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রাকে হেজার্ডাস বলেই অভিহিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বায়ুমান যাচাইয়ের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়াল।
এখনই এ দূষণ কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে আগামী তিন মাসে ঢাকার পরিস্থিতি হবে আরও ভয়াবহ। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস)-এর পরিচালক, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘মোট ৬টি উৎস থেকে ঢাকায় এভাবে বায়ুদূষণের মাত্রা মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। আগে আমরা মনে করতাম ইটভাটার কারণে বায়ুদূষণ বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ঢাকায় স্ট্রিট বেজড বায়ুদূষণের মাত্রাই বেশি। যা প্রায় ৪৫ ভাগ।’
অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘নারায়নগঞ্জের কোল থেকে শুরু করে টঙ্গি-গাজীপুর পর্যন্ত- এই বিশাল এরিয়ায় ছোট-বড় বাড়ি থেকে শুরু করে বড় বড় প্রকল্পের নির্মাণ কাজ চলছে। যে কারণে বায়ুদূষণের মাত্রাও বাড়ছে প্রতি বছর। দেখা যাচ্ছে, ২০১৬ সালের জুলাই মাস থেকে বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে ঢাকায়। এরপর থেকে বায়ুদূষণের মাত্রাও বাড়তে শুরু করেছে। গত পাঁচ বছরে প্রতিটি জানুয়ারির তুলনায় ২০২১ সালের জানুয়ারিতে বায়ূদূষণ বেড়েছে প্রায় ১৫ ভাগ।’
যে উৎসগুলো থেকে বায়ুদূষণ বাড়ছে সে সম্পর্কে তথ্য জানিয়ে সোর্স আছে ৬টি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারণ করা মান হচ্ছে- বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা পিএম-১, পিএম-২.৫ ও পিএম-১০। এগুলোর পরিমাণ পরিমাপ করেই বায়ুর মান নির্ধারণ করা হয়। তবে এখন ঢাকার বাতাসে মূলত সুক্ষ্ম ধুলিকনার উপস্থিতিই বেশি।
অধ্যাপক কামরুজ্জামান বলেন, ‘এতদিন আমরা ভাবতাম, ইটের ভাটাই প্রধান সোর্স। কিন্তু আসলে তা নয়। এখন বড় সোর্স হয়ে গেছে রাস্তা কেন্দ্রিক। ২ ধরনের সোর্স রয়েছে এই কেন্দ্রিক। কনস্ট্রাকশন এবং জানবাহন। অপরিকল্পিত কনস্ট্রাকশনের ফলে বাতাসে ধুলিকনা বেড়ে যাচ্ছে প্রচুর। নির্মাণ সামগ্রি ঢেকে রাখা হচ্ছে, যত্র-তত্র এমনকি রাস্তার ওপরও ফেলে রাখছে। যে কারণে বাতাসে দূষণের পরিমাণ হচ্ছে ৩০ ভাগ। দ্বিতীয় যে সোর্স সেটি হচ্ছে যানবাহন। রাস্তায় পুরনো জীর্ণ-শীর্ণ গাড়ীর কারণে ১৫ ভাগ বায়ু দূষণ হচ্ছে। এই দুই সোর্স থেকেই মোট ৪৫ ভাগ দূষণ হচ্ছে।’
ক্যাপস-এর পরিচালক আরও ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘ইটের ভাটা, শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়ার কারণে বায়ু দূষণ হচ্ছে ২৯ ভাগ। আন্তঃদেশীয় তথা সীমান্ত পেরিয়ে অন্য দেশ থেকে আসা বায়ু দূষণ ১০ভাগ। এছাড়া রান্না-বান্না থেকে ৯ ভাগ এবং বর্জ্য পোড়ানো থেকে ৭ ভাগ বায়ু দূষণ হচ্ছে।’
একটি ভয়ঙ্কর তথ্য তুলে ধরেছেন অধ্যাপক কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘গ্লোবাল এয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি বছর ঢাকা বায়ুদূষণের কারণে মানুষ মারা যাচ্ছে প্রায় ২৫ হাজার। তাহলে দেখুন, করোনায় মারা গেছে এক বছরে ৭ হাজার আর বায়ু দূষণে মারা গেছে আরও কয়েকগুণ বেশি। অথচ, আমরা এ দিকটা নিয়ে কোনোভাবেই সচেতন নই।’
এই মুহূর্তে বায়ুদূষণ কমাতে হলে কি করতে হবে তার একটা উপায়ও বলে দিয়েছেন অধ্যাপক কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘যদি ইনস্ট্যান্ট অ্যাকশন প্ল্যান কিংবা স্বল্প মেয়াদে বায়ুদূষণ কমানোর উপায় বলেন, তাহলে আমি বলবো- প্রচুর পানি ছিটাতে হবে। রাস্তার ওপর ধূলিদূষণ কমাতে হলে- কয়েকঘণ্টা অন্তর অন্তর পানি ছিটাতে হবে। পানি দেয়ার পর দেখা গেছে একই স্থানে ২০ ভাগ বায়ূদূষণ কমে যায়। প্রতিবছর নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি- এই চারমাস ৬০ ভাগ বায়ুদূষণ বেড়ে যায়। যদি সঠিকভাবে পানি ছিটানো যায়, রাস্তার পাশে গাছপালায় জমে থাকা ধূলাবালি সেই পানিতে কমিয়ে আনা যায়, তাহলে অন্তত ৬ হাজার মানুষের মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব বলে আমি মনে করি। যেটা করোনায় এক বছরে মৃত্যুর প্রায় সমপরিমাণ।’
অধ্যাপক কামরুজ্জামান হাইকোর্টের দুটি নির্দেশণা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘মহামান্য হাইকোর্ট ২০২০ সালের জানুয়ারি এবং ডিসেম্বর মাসে ২টি নির্দেশনা দিয়েছেন। যেখানে পানি ছিটানোর কথা বলা আছে। সেই নির্দেশনা মানলে এবং কনস্ট্রাকশনের টেন্ডারে যেসব নিয়মাবলী উল্লেখ করা থাকে, সেগুলো মেনে কনস্ট্রাকশনের কাজ করলেও বায়ু দূষণ অনেক কমানো সম্ভব।’