আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় থাকে তখনই নানাকারণে বাংলাদেশ কলঙ্কিত হয়: তারেক রহমান
বিএনপি আয়োজিত ভার্চুয়াল আলোচনাসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
সভায় তারেক রহমান বলেন বিজয়ের ৪৯ বছর পরও দেশের আজকের বাস্তবতা হলো, স্বাধীন দেশের নাগরিকরা নিজ দেশেই পরাধীন, শুধু নিজ দেশে পরাধীনই নয়, ধীরে ধীরে দেশের ভৌগোলিক স্বাধীনতাও হুমকির মুখে ফেলে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল স্বাধীনতার জন্য আর এখন চলছে স্বাধীনতা রক্ষার আন্দোলন, গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, আইনের শাসন, ন্যায় বিচার এবং মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।
তারেক রহমান বলেন, সাম্য-মানবিক মর্যাদা-ন্যায় বিচার, স্বাধীনতার মুক্তিযুদ্ধের এই তিন মূলমন্ত্রের একটিও এখন বাংলাদেশে অবশিষ্ট নেই। বর্তমানে যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জবর দখল করে রয়েছে, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশেও তারাই ক্ষমতায় ছিল এবং শুরু থেকেই তারা বাংলাদেশকে নিজেদের ভোগদখলীয় সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার করছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, একটি রাষ্ট্র কতটা উন্নত, সভ্য ও টেকসই, সেটি নির্ভর করে একটি রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহনে কতটা স্বাধীন তার ওপর। কোনো রাষ্ট্র যদি উল্টো পথে চলার চেষ্টা করে কিংবা সরকার যদি স্বৈরাচারী কিংবা গণবিরোধী হয়ে ওঠে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সরকারকে সঠিক ধারায় ফেরাতে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্বপূর্ন অপরিসীম। কিন্তু বাংলাদেশে একজন মাত্র ব্যক্তির ক্ষমতালিপ্সার কারণে বর্তমানে রাষ্ট্রের প্রতিটি সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।
তারেক রহমান বলেন, একটি রাষ্ট্রের স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা কত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে তার একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ বিশ্ববাসী দেখেছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর। আমেরিকার ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট অসীম ক্ষমতার অধিকারী হলেও দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেখিয়েছে আইনগত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রেসিডেন্টের চেয়েও শক্তিশালী, স্বাধীন ও স্বতন্ত্র। অথচ বাংলাদেশে ঠিক এর উল্টো চিত্র। নিজেদের সাংবিধানিক দায়িত্ব ভুলে গিয়ে সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হয়েছে আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনে।
তিনি আরো বলেন, দেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার চর্চার অন্যতম প্রধান মাধ্যম নির্বাচন। নির্বাচন ছাড়া ভোটাধিকার চর্চার সুযোগ নেই। নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের। অথচ নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় নির্বাচনী কার্যালয়ে পরিণত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনে বসে থাকা কয়েকটা অপদার্থ ও মেরুদন্ডহীন প্রাণীর কাজ হলো আওয়ামী লিগ অফিস থেকে পাঠানো তালিকা দেখে কাউকে এমপি কিংবা চেয়ারম্যান ঘোষণা করা, অভিযোগ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের।
তারেক রহমান বলেন, রাষ্ট্রের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হলো দুর্নীতি দমন কমিশন। অথচ এই অফিসটি এখন নিজেরাই আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্থ। গত একদশকে দেশ থেকে নয় লক্ষ কোটি টাকা পাচার হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের টাকাপাচারকারীরা কানাডায় বেগমপাড়া গড়ে তুলেছে, হলমার্ক কেলেংকারির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংক থেকে ৩৬ শ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ফান্ড থেকে লোপাট হয়েছে আটশো ১০ কোটি টাকা, এই সরকারের একেকটি মেগা প্রকল্প মানেই মেগা দুর্নীতি। জনগণ জানতে চায়, এসব ক্ষেত্রে দুদকের ভূমিকা কি?
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং জনগণের মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায় দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আইন বিভাগ। আইন বিভাগ এখন নিজেরাই নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্ব ও মর্যাদার কথা ভুলে গিয়ে পরিণত হয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি বিভাগে। মানুষ বিপদগ্রস্থ কিংবা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে আদালতের দ্বারস্থ হবে এটাই একটি সভ্য রাষ্ট্র ও সমাজের এমনটিই হওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশে উল্টো চিত্র।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অভোযোগ করে বলেন, দেশের সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকার দেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করছে। এর কারণ, তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিচ্ছে। বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে তারা প্রতিশোধ নিচ্ছে। কেন এই প্রতিশোধ? কারণ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে দায়িত্ব নিয়ে আওয়ামী লইগ দেশ পরিচালনায় সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। সফল হয়েছিল বিএনপি।
আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা আর বিএনপির সফলতার কথা বলতে গিয়ে তারেক রহমান বলেন, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে একদলীয় কুখ্যাত একদলীয় বাকশাল চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল, নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল আওয়ামী লীগসহ সবগুলো রাজনৈতিক দল। বিপরীতে, জিয়াউর রহমান সবগুলো রাজনৈতিক দলের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। সবাইকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে জোর করে সবাইকে বাঙালি বানাতে গিয়ে অন্য ভাষা ও গোষ্ঠীর মানুষের মনে অবিশ্বাস ও বিরোধের জন্ম দেয়া হয়েছিল বিপরীতে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিটি নাগরিকের সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় জিয়াউর রহমান দিয়েছিলেন ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে’র দর্শন। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে সেনাবাহিনীকে দুর্বল করতে প্যারালাল খুনি রক্ষীবাহিনীর জন্ম দেয়া হয়েছিলো। বিপরীতে, জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীকে একটি সম্পূর্ণ পেশাদার এবং শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ক্ষমতার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে দেশে খুন সন্ত্রাসের রাজত্ত্ব কায়েম হয়েছিল বিপরীতে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে খুন সন্ত্রাস বন্ধ হয়ে যায়।
স্বাধীনতার ঘোষকের শাসনামলে দেশের মানুষ স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল পেতে শুরু করে। মানুষ বুঝতে শুরু করে শাসক আর সেবকের মধ্যে পার্থক্য। এখানেই জিয়াউর রহমান অনন্য। এখানেই বিএনপি’র সাফল্য, বলেন তারেক রহমান।
তারেক রহমান আরো বলেন, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি, ব্যাংক ডাকাতি এবং বেপরোয়া লুটপাটে বিশ্বে বাংলাদেশ পরিচিতি পেয়েছিলো ‘তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র কলঙ্ক থেকে বের করে আনেন। বিশ্বে বাংলাদেশ পরিচিতি পায় একটি আধুনিক ও কল্যানকর রাষ্ট্র হিসেবে।তারেক রহমান বলেন, ষড়যন্ত্রের পথ ধরে ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ আরো একদফা ক্ষমতায় আসে। এরপর বাংলাদেশকে বিশ্বে প্রথমবারের মতো দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে ২০০১ সালে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়। তিনি বলেন, আওয়ামী লিগ যখনি ক্ষমতায় থাকে তখনি বাংলাদেশ দেশে বিদেশে নানাকারণে কলংকিত হয়। সম্প্রতি বিশ্বের সাতটি মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশেকে কতৃত্ববাদী শাসন থেকে বের করে আনার জন্য গণতান্ত্রিক বিশ্বের প্রতি আহবান জানিয়েছে। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কতিপয় খুনি কর্মকর্তাকে আমেরিকা এবং ইউরোপে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব উত্থাপিত হচ্ছে।
তারেক রহমান সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ক্ষমতার ভোগদখলকে কেন্দ্র করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের দোসররা দেশে এক নৈরাজ্যকর অবস্থার জন্ম দিয়েছিলো। কিন্তু দেশপ্রেমিক সিপাহী জনতা ঐতিহাসিক বিপ্লবের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর আওয়ামী লিগে এবং তাদের দোসরদের পরাজিত করেছিল। ৭৫ সালের নভেম্বরের পরাজিত সেই অপশক্তি মহাজোটের নামে একজোট হয়ে আবারো বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী ভূমিকায় লিপ্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, ৭৫ সালের নভেম্বরের পরাজিত এই অপশক্তির টার্গেট দেশের জাতীয়তাবাদী শক্তি এবং দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে রাখা। সে কারণেই ৭৫ সালের নভেম্বরের পরাজিত অপশক্তি স্বাধীনতার ঘোষকের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। দেশের জাতীয়তাবাদী শক্তির ঐক্যের প্রতীক মাদার অফ ডেমোক্র্যাসি বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার চালাচ্ছে। বিএনপির বিরুদ্ধে চালানো হচ্ছে ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র।
তারেক রহমান অভিযোগ করে বলেন, দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই ৭৫ এর পরাজিত অপশক্তির ইন্ধনে ২০০৪ সালে ‘২১ আগস্ট’ এর ঘটনা ঘটে। ‘২১ আগস্ট’ এবং কথিত ‘ওয়ান-ইলেভেন’ একই সূত্রে গাঁথা। একটি ‘ওয়ান-ইলেভেন’ এর নাটক মঞ্চস্থ করার জন্যই পরিকল্পতিভাবে ‘২১ আগষ্টের ঘটনা’ ঘটানো হয়েছিলো। ৭৫ সালের নভেম্বরে যারা দেশকে উল্টো পথে নিতে ব্যর্থ হয়েছিল ২০০৭ সালের কথিত ‘ওয়ান-ইলেভেনে’র মাধ্যমে তারা সফল হয়। ‘২১ আগষ্ট’ আর ‘ওয়ান ইলেভেনের’ নামে ষড়যন্ত্রের পথ ধরে ক্ষমতা দখল করেই ৭৫ এর নভেম্বরের পরাজিত অপশক্তি বিডিআর পিলখানায় সেনা হত্যাযজ্ঞ চালায়। সেনা হত্যাযজ্ঞটি ছিল ৭৫ এর নভেম্বরের পরাজিত অপশক্তির প্রতিশোধের একটি অংশ।
‘স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস সাক্ষী, দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী শক্তি এবং সেনাবাহিনী শক্তিশালী থাকলে ৭৫ এর নভেম্বরের পরাজিত অপশক্তির কোনো ষড়যন্ত্রই সফল হবেনা। তাই আমি বিশেষ করে সারা দেশে আমার দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, দেশের জনগণ এখন একটি অর্থবহ পরিবর্তনের পক্ষে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে অতীতের মতো এই পরিবর্তনের নেতৃত্ব বিএনপিকেই দিতে হবে। কারণ প্রমাণিত হয়েছে, বাংলাদেশের যা কিছু অর্জন সেটি বিএনপি সরকারের মাধ্যমেই হয়েছে। বিএনপি-ই দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। বিএনপিই দশে সংসদীয় পদ্ধতির গণতন্ত্র চালু করেছে।