অর্থনীতিতে করোনা-উত্তর পুনরুদ্ধারের লক্ষণ নেই
করোনার কারণে জনচলাচলে বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার পরও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কোনো লক্ষণ সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। চলতি অর্থবছরের জন্য সরকার ৭.৭ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করছে অথচ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রাজস্ব খাতে ব্যাপক ঘাটতি থেকে গেছে। এই সময়ে সার্বিক রাজস্ব আদায় বেড়েছে মাত্র ৮ শতাংশ, যার মধ্যে কর রাজস্ব বেড়েছে মাত্র ২.৬ শতাংশ। সম্পদ আহরণে এই দুরবস্থার কারণে উন্নয়ন কর্মসূচির অর্থ ব্যয়ে এক ধরনের অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এই সময়ে যে বাজেট ব্যয় হওয়ার কথা তার চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে নতুন ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের হিসাব মেলাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের হিমশিম খেতে হবে।
সামস্টিক অর্থনীতি ও রাজস্ব পরিস্থিতি সম্পর্কিত সদ্য প্রকাশিত ২০২০ সালের অক্টোবরের প্রতিবেদনের তথ্যে সামস্টিক অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে দুরবস্থা ফুটে ওঠে। অর্থ মন্ত্রণালয় এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুসারে ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে মোট রাজস্ব আয় ৮.০১ শতাংশ বেড়েছে। কর বহির্ভূত রাজস্ব খাতে এ সময় ৩৬.৮০ শতাংশ আয় বৃদ্ধি পায় আর কর রাজস্ব খাতে রাজস্ব বৃদ্ধি পায় ২.৬৫ শতাংশ। এ সময়ে কোভিড-১৯ মহামারীজনিত কারণে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ধীরভাবে বাস্তবায়নের ফলে উন্নয়ন ব্যয় ৩৪.৫৭ শতাংশ কমে গেছে। এর ফলে মোট সরকারি ব্যয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২.৮৭ শতাংশ কমেছে। এতে ২০২০-২১ অর্থবছরের অক্টোবরের শেষে অনুদানসহ সামগ্রিক বাজেটের ভারসাম্যে ১৯৬.৮৭ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থেকে গেছে।
মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সার্বিক রাজস্ব আয় মাত্র ৪.৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে কর রাজস্ব ৪.৯৩ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হলেও কর বহির্ভূত রাজস্ব ৬৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থবছর শেষে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়। চলতি অর্থবছরে এসেও সেই কর বহির্ভূত রাজস্ব প্রবৃদ্ধির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে সরকারকে। এই চার মাসে প্রায় ৩৭ শতাংশ রাজস্ব বেড়েছে কর বহির্ভূত খাত থেকে। মূলত বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের রিজার্ভ তহবিল থেকে মুনাফা হিসাবে অর্থ নিয়ে এই রাজস্ব দেখানো হচ্ছে বলে একটি সূত্র উল্লেখ করেছে।
আর্থিক খাতের যে চিত্র এই প্রতিবেদনে দেয়া হয়েছে তাতে ঋণের বিস্তার সরকারি খাতের ঋণনির্ভর হয়ে গেছে বলে মনে হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০-২১ অর্থবছরের অক্টোবর শেষে ব্যাপক অর্থ সরবরাহ (এম-২) আগের অর্থবছরের একই সময়ে তুলনায় ১৪.১০ শতাংশ বেড়েছে। এ সময়ে নেট ব্রড অ্যাসেট (এনএফএ) ২৪.৬৭ শতাংশ এবং নেট ডমেস্টিক অ্যাসেট (এনডিএ) ১১.২২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। এ সময়ে রিজার্ভ অর্থের পরিমাণ ১৫.১৯ শতাংশ বেড়েছে। অন্য দিকে গত ৩১ ডিসেম্বরের বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে নভেম্বর মাসের শেষ নাগাদ মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ বেড়েছে ১০.৫৬ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে ২৫.৮৮ শতাংশ আর রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে ঋণ বেড়েছে ১৩.৬৯ শতাংশ। অথচ একই সময়ে বেসরকারি খাতের ঋণের বিস্তৃতি ঘটেছে মাত্র ৮.২ শতাংশ।
বৈদেশিক খাতের মিশ্র চিত্র পাওয়া যায় অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে। এতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস জুলাই-অক্টোবরে রফতানি বেড়েছে মাত্র ০.৯৭ শতাংশ আর একই সময়ে আমদানির পরিমাণ আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১২.৯৬ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে নভেম্বর ’২০ মাসেও রফতানি বেড়েছে মাত্র ০.৭৬ শতাংশ। নভেম্বর মাসে আমদানি অবশ্য ৯.৬ শতাংশ বেড়েছে। মূলত খাদ্যশষ্য ও পেঁয়াজের জন্য এই আমদানি ব্যয় বেড়েছে বলে জানা গেছে।
বৈদেশিক খাতের মধ্যে রেমিট্যান্সের চিত্র অস্বাভাবিক ধরনের বিকাশের। অর্থবছরের প্রথম চার মাসে, রেমিট্যান্স প্রবাহ ৪৩.৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর নভেম্বরে বেড়েছে ৩৩.৬৬ শতাংশ। শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং আমদানি হ্রাস বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তৈরিতে অবদান রাখছে, যা অর্থবছরের অক্টোবরের শেষে ৪০.৮২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দাঁড়িয়েছে। এই রিজার্ভ ৯.২২ মাসের আমদানি বিলের সমতুল্য। সর্বশেষ ৩১ ডিসেম্বরে এই রিজার্ভ দাঁড়ায় ৪৩.১৭ বিলিয়ন ডলার। উচ্চ হারের এই রেমিট্যান্স প্রবাহের সাথে দেশ থেকে পাচার হওয়া বিপুল তহবিল এবং ২ শতাংশ রেমিট্যান্স প্রণোদনার একটি সম্পর্ক রয়েছে বলে অনেকের ধারণা।
অর্থনীতিতে চলতি অর্থবছরে সরকার ৭.৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে প্রাক্কলন করেছে সেবা খাতের উচ্চ প্রবৃদ্ধি হবে ধরে নিয়ে। অথচ সেবা খাতের বেশির ভাগ উপখাতে উৎপাদন পরিস্থিতি নেতিবাচক। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৯ সালের আগস্টের তুলনায় ২০২০ সালের আগস্টে বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পের উৎপাদন কোয়ান্টাম সূচক মাত্র ৪.৯৯ শতাংশ বেড়েছে। চামড়া সম্পর্কিত পণ্যগুলো ৯.১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পরে ফার্মাসিউটিক্যালস বৃদ্ধি পেয়েছে ৮.২৯ শতাংশ আর খাদ্যপণ্য উৎপাদন ১৩.৭৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এই সময়ে ব্যবসায়বাণিজ্য শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে এক ধরনের অচলাবস্থা বিরাজ করে। এরপরও সেবা খাতে উচ্চ হারের প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুসারে চলতি অর্থবছরের অক্টোবর শেষে ১২ মাসের আবর্তক গড় মুদ্রাস্ফীতি ৫.৭৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যার মধ্যে খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৫.৮৭ শতাংশ এবং ৫.৬২ শতাংশ। ৬ শতাংশের কাছাকাছি মুদ্রা মান কমে গেলে ৮ শতাংশের কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি হতে হলে চলতি মূল্যে ১৪ শতাংশ আয় বাড়তে হবে দেশের মানুষের। অথচ সরকারি খাত ছাড়া বাকি বেসরকারি খাতের বেশির ভাগেই আয় কমে গেছে। করোনার সময় অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে বেতন ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দেয়া হয়েছে।