দেশে চলমান ভাস্কর্য ইস্যু নিয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
দেশে চলমান ভাস্কর্য ইস্যু নিয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দেশে ধর্মীয় যেকোনও ইস্যুকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হয়ে ওঠে কিছু গোষ্ঠী বা ব্যক্তি। অনলাইন থেকে প্রকাশ্যে সবখানেই তাদের তৎপরতা বেড়েছে। এরই মধ্যে কুষ্টিয়া পৌর শহরের পাঁচ রাস্তার মোড়ে বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্যে ভাঙচুর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুসূদন স্মৃতি ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন ভাস্কর্য ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাড়তি সতর্কতায় রয়েছে। গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদারের পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক উগ্রপন্থিদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে পুলিশ। বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের তৎপরতা পরিলক্ষিতও হচ্ছে।
বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা যেমন- পুলিশ, র্যাব, সিআইডি, পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি), কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ও অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) সারা দেশেই গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করেছে।
গত বুধবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের সামনে স্থাপিত মধুসূদন দে স্মৃতি ভাস্কর্যের একটি কান ভেঙে ফেলে দুর্বৃত্তরা। কুষ্টিয়া পৌর শহরের পাঁচ রাস্তার মোড়ে বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙচুর করে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবসহ অনলাইনের বিভিন্ন মাধ্যমে ভাস্কর্যবিরোধী নানা ধরণের তৎপরতায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে উগ্রপন্থিরা। যদিও এসব উগ্রপন্থির সঙ্গে দেশের নিষিদ্ধঘোষিত কোনও জঙ্গি সংগঠনের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়নি জঙ্গিবাদ ও জঙ্গি কর্মকাণ্ড অনুসরণকারী ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বিষয়টি স্পর্শকাতর। একদিকে ধর্মীয় বিষয়, আরেক দিকে জাতির জনক বন্ধবন্ধুর প্রতিকৃতি। এ কারণে অনেক সাবধানে বিষয়টি হ্যান্ডেল করা হচ্ছে। তবে কেউ ভাস্কর্য বিনষ্ট করার মতো কাজ করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) সহকারি পুলিশ সুপার (লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া) ওয়াহিদা পারভীন বলেন, ‘অনলাইন থেকে যেসব প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানো হচ্ছে, সেগুলো আমাদের সাইবারের কয়েকটি উইং মনিটরিং করছে। দেশে ধর্মকে পুঁজি করে জঙ্গিবাদে জড়িত হওয়া কিংবা যারা ধর্মের অপব্যাখ্যা দিচ্ছে, তাদেরকেও নিয়মিত নজরদারিতে রাখা হয়েছে। যারা এসব ব্যাপারে উস্কানি দিয়ে জঙ্গিবাদের দিকে অথবা সহিংসতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে এটিইউ কাজ করছে।’
পুলিশ সদর দফতরের মুখপাত্র ও সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মো. সোহেল রানা বলেন, ‘আমরা জনগণকে অনুরোধ করছি ধর্মের কোনও ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তাদেরকে যেনও কেউ বিভ্রান্ত করতে না পারে। কোনও স্বার্থান্বেষী মহলের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে তাদেরকে যেনও কাজে লাগাতে না পারে। জাতীয় স্বার্থে দেশের আইনের প্রতি প্রত্যেককে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘যারা দেশের শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে, তাদের প্রতি নজর রাখা হচ্ছে। বাংলাদেশ পুলিশ দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর।’
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের উপ-কমিশনার (ডিসি) আ ফ ম আল কিবরিয়া বলেন, ‘ভাস্কর্য ইস্যুতে যারা জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, তাদের ফেসবুক আইডি, পেজ ও গ্রুপ আমাদের নজরদারিতে আছে। আইডিগুলো শনাক্তের পর তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ভাস্কর্য ইস্যুতে যারা সক্রিয় হয়ে উঠেছে এখন পর্যন্ত তাদের সঙ্গে নিষিদ্ধ কোনও জঙ্গি সংগঠনের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে বিষয়টি নজরদারির মধ্যে রয়েছে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুসূদন স্মৃতি ভাস্কর্য ভাঙচুরকারীদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সম্ভাব্য ভাঙচুরকারী ও উগ্রপন্থিদের তালিকা করা হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় বিভিন্ন ভাস্কর্যকেন্দ্রিক গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।’
সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সোচ্চার, ‘তাদের সবাই সন্দেহভাজন অপরাধী নয়। তাদের সিংহভাগই আবেগের স্রোতে গা ভাসিয়েছে। এই আবেগপ্রবণ মানুষদের কারা ব্যবহার করছে, সেটাই সাইবার পুলিশ নজরদারি করছে এবং নিয়মিত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করছে। তালিকাটা খুব দীর্ঘ নয়, ২০ থেকে ২৫ জন। তাদের প্রত্যেকের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
তারা আরও জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা অনলাইনে পোস্ট প্রদানকারীদের মাধ্যমে আইন ভঙ্গ হচ্ছে কি-না তা যাছাই করে ফেসবুক বা ইউটিউব কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হচ্ছে।
সিআইডির সাইবার পুলিশ ইউনিটের বিশেষ সুপার মোহাম্মদ রেজাউল মাসুদ বলেন, ‘জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য একটি গ্রুপ সক্রিয় হয়েছে। তাদেরকে নজরদারিতে রেখেছে সিআইডি। এরমধ্যে ২০-২৫টি ফেসবুক আইডি শনাক্ত করা হয়েছে। এই আইডিগুলো দেশে-বিদেশে থেকে বিভ্রান্ত ছড়ানো হচ্ছে।’
জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘চলমান ভাস্কর্য ইস্যুকে কেন্দ্র করে যে ধরণের উস্কানি কিংবা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে, এ ব্যাপারে র্যাব তিনটি স্তরে অত্যন্ত সতর্ক অবস্থায় দায়িত্ব পালন করছে। প্রথম স্তরটি- সাদা পোশাকে সারা দেশে র্যাবের গোয়েন্দারা নিয়োজিত আছে। দ্বিতীয়ত- পোশাকধারী সদস্যরা টহল কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের স্থিতিশীল অবস্থা বজায় রাখতে সচেষ্ট রয়েছে। সর্বোপরি কেউ যাতে অনলাইনের মাধ্যমে কোনও ধরণের বিভ্রান্তি উস্কে দিতে না পারে, সে লক্ষ্যে সাইবার মনিটরিং টিম সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োজিত আছে।’ এছাড়া যেকোনও ধরণের বিশৃঙ্খলমূলক কর্মকাণ্ডের তথ্য পেলে র্যাব কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলেও তিনি জানিয়েছেন।