বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির প্রবণতা বাড়ছে
টানা দরপতনে দেশের শেয়ারবাজারে অস্থিরতা কাটছে না। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) কমছে বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারের দর। কমে গেছে সূচক ও বাজার মূলধন। এতে পুঁজিবাজারের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ তলানিতে নেমেছে। প্রতিনিয়ত পুঁজি হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। বাধ্য হয়ে লোকসান দিয়েও শেয়ার বিক্রি করছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও শেয়ার বিক্রি করে পুঁজিবাজার ছাড়ছেন। গত কয়েক মাস থেকে তাদের বিনিয়োগ তুলে নেয়ার প্রবণতা অব্যাহতভাবে বেড়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে- বেশির ভাগ যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিনিয়োগ কোম্পানি। এছাড়া সিঙ্গাপুর, দুবাইভিত্তিক কিছু বিনিয়োগ কোম্পানিও রয়েছে। নরডিক দেশগুলোর ব্যবসায়ীদের সমন্বিত বিনিয়োগ কোম্পানি ব্রামার্স অ্যান্ড পার্টনার্স দেশের শেয়ারবাজারে প্রায় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে বিদেশিদের বিনিয়োগ সর্বাধিক ৪০ থেকে ৪৩ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা রয়েছে। শীর্ষস্থানীয় ব্রোকারেজ হাউসের এক কর্মকর্তা জানান, বিদেশিরা স্কয়ার ফার্মা, গ্রামীণফোনের মতো বড় মূলধনী শেয়ারগুলো বিক্রি করছে বেশি। তাদের বিক্রির কারণে এ ধরনের শেয়ারগুলোর দর ক্রমাগত কমছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৮ সাল থেকেই পুঁজিবাজার থেকে বিদেশিরা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সাধারণত ডলারে বিনিয়োগ করেন। তাদের বিনিয়োগের বিপরীতে যে মুনাফা আসে, সেটিও ডলারে রূপান্তর করেই বিদেশে নিয়ে যান। এদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেছে। টাকার অবমূল্যায়নের সঙ্গে দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লেনদেনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ডলারের বিপরীতে টাকা যত দুর্বল হয়েছে, বিদেশিদের মধ্যে শেয়ার বিক্রির প্রবণতাও তত বেড়েছে।
বিশ্লষকদের মতে, পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ খুব বেশি না হলেও এর একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়লে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরাও পুঁজিবাজারে আসতে থাকেন। আবার বিদেশিদের বিনিয়োগ কমে গেলে স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও বাজার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ২২ মাসে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩.৫৪ শতাংশ। এর মধ্যে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮২ টাকা ৮২ পয়সা। ডিসেম্বরে এসে তা ৮৩ টাকা ৯০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। এ বছরের জানুয়ারিতে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৩ টাকা ৯৪ পয়সা, যা অক্টোবর শেষে ৮৫ টাকা ৭৫ পয়সায় এসে দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে ডিএসই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লেনদেন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ২২ মাসের মধ্যে মাত্র ৫ মাস বিদেশিরা শেয়ার বিক্রির চেয়ে বেশি কিনেছেন। আর বাকি ১৭ মাসই তারা কেনার চেয়ে বেশি শেয়ার বিক্রি করেছেন। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিট লেনদেন ছিল ১৮৭ কোটি টাকা। পরের মাস ফেব্রুয়ারিতে এসে এটি ঋণাত্মক ৯৪ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। মার্চে আবার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিট লেনদেন দাঁড়ায় ১৫৬ কোটি টাকায়। এর পরের ৫ মাস ডিএসইতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিট লেনদেন ছিল ঋণাত্মক। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বিক্রির চেয়ে কেনার পরিমাণ বেশি হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিট লেনদেন হয় ৩৫ কোটি টাকা। এর পরের তিন মাস অর্থাৎ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএসইতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিট লেনদেন ছিল ঋণাত্মক। এ বছরের প্রথম দুই মাস পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রির চেয়ে কিনেছেন বেশি। এর মধ্যে জানুয়ারিতে নিট বৈদেশিক লেনদেন ছিল ১৭৫ কোটি টাকা; ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৩২৩ কোটি টাকা। অবশ্য এর পর থেকেই টানা আট মাস দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কেনার চেয়ে শেয়ার বিক্রি করেছেন বেশি।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট মো. শাকিল রিজভী বলেন, দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা যখন বিনিয়োগ করেন তখন সবাই তাদের অনুসরণ করেন। আবার তারা যখন বাজার থেকে বেরিয়ে যান তখন অন্য বিনিয়োগকারীরাও তাদের পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দেন। তবে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অত্যন্ত কৌশলী। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বর্তমানে তারা শেয়ার কেনার চেয়ে বিক্রি করছেন বেশি। অন্যদিকে সূচক কমার কারণে যখন ভালো কোম্পানির শেয়ারদর যথেষ্ট কমে যায় বিদেশিরা তখন শেয়ার কেনার পরিমাণ বাড়িয়ে দেন।
ডিএসইর তথ্যমতে, গত ৮ মাসে বিদেশিরা ২ হাজার ২২৩ কোটি টাকার শেয়ার ও ইউনিট কিনেছেন। এর বিপরীতে বিক্রি করেছেন ৩ হাজার এক কোটি টাকার। অর্থাৎ, কেনার চেয়ে ৭৭৮ কোটি টাকার শেয়ার ও ইউনিট বেশি বিক্রি করেছেন তারা।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অক্টোবরে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ২৩১ কোটি ৯৯ লাখ ৭২ হাজার ১০২ টাকার শেয়ার কিনেছেন। এর বিপরীতে ৩২৮ কোটি ৯২ লাখ ৫৬ হাজার ৩৮৪ টাকার শেয়ার বিক্রি করেছেন। সে হিসাবে এ সময়ে ৯৬ কোটি ৯২ লাখ ৮৪ হাজার ২৮২ টাকার শেয়ার বেশি বিক্রি করেছেন। অক্টোবরে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিওতে মোট ৫৬০ কোটি ৯২ লাখ ২৮ হাজার ৪৮৬ টাকার লেনদেন হয়েছে। এর আগের মাসে লেনদেন ছিল ৫৭৫ কোটি ৯৩ লাখ ২৬৮ টাকা। সে হিসাবে বিদেশি পোর্টফোলিওতে লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে ১৫ কোটি ৭১ হাজার ৭৮২ টাকা।
এদিকে সেপ্টেম্বরে বিদেশিরা ডিএসইর মাধ্যমে ২৫৭ কোটি ৭৮ লাখ ৭১ হাজার ৪৮০ টাকার শেয়ার কেনেন। বিপরীতে বিক্রি করেছেন ৩১৮ কোটি ১৪ লাখ ২৮ হাজার ৭৮৮ টাকার শেয়ার। ওই সময় তারা ৬০ কোটি ৩৫ লাখ ৫৭ হাজার ৩০৮ টাকার শেয়ার বেশি বিক্রি করেছেন।
আগস্টে বিদেশিরা ১৭৬ কোটি ৭৮ লাখ তিন হাজার ৪০৮ টাকার শেয়ার কেনেন। বিপরীতে বিক্রি করেছেন ২৭৯ কোটি ৩১ লাখ ৮৪ হাজার ৯১১ টাকার শেয়ার। ফলে আগস্টে ১০২ কোটি ৫৩ লাখ ৮১ হাজার ৫০৩ টাকার শেয়ার বিক্রি বেশি করেছেন বিদেশিরা। জুলাইয়ে বিদেশিরা ৩০৯ কোটি ৩৬ লাখ ৩৭ হাজার ৮৩৯ টাকার শেয়ার কেনেন। বিক্রি করেছেন ৪৭৪ কোটি তিন লাখ ৪৬ হাজার ১৮ টাকার শেয়ার। ফলে জুলাইয়ে ১৬৪ কোটি ৬৭ লাখ আট হাজার ১৭৯ টাকার শেয়ার বিক্রি বেশি করেছেন।
একইভাবে এপ্রিলে ১৫৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকা, মে মাসে ৬৫ কোটি ১৭ লাখ ও জুনে ১০ কোটি ৫২ লাখ টাকার বিনিয়োগ তুলে নেন বিদেশিরা। মার্চেও তাদের একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ওই মাসে বিদেশিদের মোট লেনদেন ছিল ৮৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে শেয়ার কেনা ছিল ৩৭৫ কোটি টাকার। আর বিক্রি করেছেন ৪৯৮ কোটি টাকার শেয়ার। এতে মার্চে তাদের নিট বিনিয়োগ প্রত্যাহার হয় ১২৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এ সময়ে বিক্রি বাড়িয়ে টানা বিনিয়োগ তুলে নিয়েছেন তারা।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা খুব হিসাবি। তারা মৌলভিত্তির কোম্পানি ছাড়া বিনিয়োগ করতে চান না। এজন্য বাজারে দ্রুত ভালোমানের কোম্পানির সংখ্যা বাড়ানো উচিত। কারণ আমাদের পুঁজিবাজারে খুব ভালোমানের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক কম।