সেদিন স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সিপাহি-জনতা
আজ ৭ নভেম্বর, ঐতিহাসিক দিন। সেদিন দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দেশের সিপাহি-জনতা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মুক্ত করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নায়ক, প্রাণপুরুষ জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে। দিনটিকে পালন করা হয় ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে।
৭ নভেম্বর সংঘটিত সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে তৎকালীন সেনাপ্রধান রাষ্ট্রক্ষমতায় আসলেও বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি শুরু করেছিলেন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। ৭১ আর ৭৫’র পট পরিবর্তনের পর বিধস্ত ও দিশেহারা জাতির কল্যাণে দেশের হাল ধরেছিলেন মহান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠকারী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই সেক্টর কমান্ডার।
১৫ আগস্ট এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হত্যার পরপরই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন বঙ্গবন্ধুরই অন্যতম সহচর ও আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদ। মোশতাকের সরকারের যোগদেন বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রায় সব মন্ত্রীও।
কিন্তু এসব মেনে নিতে পারেননি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম। তিনি তার অনুগত সেনা কর্মকর্তা ও সদস্য নিয়ে মোশতাকের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটান। একই সঙ্গে গৃহবন্দি করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্যতা সম্পন্ন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে। দখল করেন রাষ্ট্র ক্ষমতাও। কিন্তু সেটা স্থায়িত্ব ছিলো মাত্র ৩ দিন।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নায়ক জিয়াকে বন্দি করায় সেনানিবাসের ভেতরে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে এক চাপা উত্তেজনা চলছিল। খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থানটি রাজনৈতিক অঙ্গনে, সচেতন জনগণের এবং সৈনিকদের মনে একটি ভারতপন্থি অভ্যুত্থান হিসেবে পরিচিত পায়। তারা মনে করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে। ফলে ব্যারাক ছেড়ে দেশপ্রেমিক সৈন্যরা দলে-দলে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে রাস্তায় নেমে আসে। সেনাদের সঙ্গে যোগ দেন হাজার হাজার সাধারণ মানুষও।
এই সিপাহি-জনতার বিপ্লবের অন্যতম ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার কর্নেল (অব.) আবু তাহেরও। যিনি ছিলেন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার প্রধান এবং সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। সেনাবাহিনীর ভেতরে ছিল জাসদের গোপন সংগঠন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা, আর বাইরে ছিল গণবাহিনী। যাদের লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ ব্যবস্থা কায়েম করা।
এক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করতে চেয়েছিল জিয়াউর রহমানকে। আরও উল্লেখ্য করা প্রয়োজন জিয়াউর রহমান দেশবাসীর নিকট সুপরিচিত ছিলেন, প্রথমে নিজের নামে ও পরে মহান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করার কারণে। জিয়াউর রহমান সুপরিচিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের অন্যতম জ্যেষ্ঠ সেনাপতি হিসেবে এবং সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন একজন ডায়নামিক ও ক্যারিশমেটিক সেনাবাহিনী উপ-প্রধান এবং পরবর্তীতে প্রধান হিসেবে। জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বি।
তৎকালীন মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের (বীর প্রতীক) ভাষ্য, ‘৭ নভেম্বর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই সৈনিকদের বিপ্লবটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়। বড় অংশ ছিল অরাজনৈতিক মনোভাবসম্পন্ন নিখাদ বাংলাদেশ প্রেমিক, জিয়া-প্রেমিক সৈনিকরা। ছোট অংশ ছিল জাসদের প্রভাবান্বিত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য ও অনুসারীরা। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই ঢাকা মহানগরের জনগণ জড়িত হতে থাকেন। সূর্য উদয়ের ঘণ্টা দুয়েকের আগে থেকেই, ক্যান্টনমেন্ট থেকে সৈনিকেরা মহানগরে ছড়িয়ে পড়ে। রাতের মধ্যেই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন অংশে, একাধিক অফিসার ও অফিসারের পত্মী বিদ্রোহী বা বিপ্লবী সৈনিকদের হাতে নিহত হন। তবে কেউ কাউকে চিহ্নিত করতে পারেননি।’
তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে, এই পর্যায়ে আমার মুক্তিযুদ্ধকালীন ব্যাটালিয়ন, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে উপস্থিত থেকে ঘটনাবলির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। দ্বিতীয় বেঙ্গলের সৈনিকরা কোনো কিছুর সাথে-পাঁচে ছিলেন না, কিন্তু ৭ তারিখের প্রথম প্রহর তথা রাত একটা-দেড়টা থেকে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাপন্থি অর্থাৎ বিপ্লবী সৈনিকরা, শান্তিপ্রিয় শৃঙ্খলাপন্থি দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিনদিক থেকে বৈরী প্রচারণা এবং আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে শুরু করে। উপস্থিত জ্যেষ্ঠতম অফিসার হিসেবে, আমি পুরো ব্যাটালিয়নকে নিয়ন্ত্রণে রাখি।’
এই মুক্তিযোদ্ধার দাবি, ‘সেদিন জাসদপন্থি বিপ্লবী সৈনিকরা যেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সীমানার ভেতর অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেটা নিশ্চিত করি। কোনো অবস্থাতেই যেন, যে যেই পন্থিই হোক না কেন, সৈনিকে-সৈনিকে পারস্পরিক গোলাগুলি বিনিময় না হয়, সেটা নিশ্চিত করার জন্য পন্থা আবিষ্কার করি। অতঃপর দ্বিতীয় বেঙ্গলের সৈনিকদেরকে সিপাহী-জনতার বিপ্লবে যোগদানে সহায়তা করি। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫। জাসদপন্থি সৈনিকদের ও জাসদ কর্মীদের বিপ্লব সূর্য উদয়ের ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই, পানিতে যেমন চিনি গলে যায় ওইরকমভাবে বিলীন হয়ে যায়। জীবিত থাকে এবং শক্তিশালী হয়ে ওঠে জিয়া অনুরাগী হাজার হাজার সৈনিকের এবং হাজার হাজার জনগণের সম্মিলিত বিপ্লব। সেই অবধি এই দিনের নাম হয়েছে সৈনিক জনতার বিপ্লব বা সিপাহী জনতার বিপ্লব তথা বিপ্লব ও সংহতি দিবস।’