দেশেও তীব্র হচ্ছে ‘বয়কট ফ্রান্স’ আন্দোলন, আজ ফরাসি দূতাবাস ঘেরাও
ফ্রান্সে সম্প্রতি ক্লাসরুমে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কার্টুন দেখানোর সূত্রে একজন স্কুল শিক্ষকের শিরচ্ছেদের ঘটনার পর ইসলাম ধর্ম নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোর সাম্প্রতিক কিছু মন্তব্যের প্রতিবাদে মধ্যপ্রাচ্যের কাতার, জর্ডান, কুয়েতসহ কয়েকটি মুসলিম দেশে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে।
অনেক দোকান থেকে ফরাসি পণ্য সরিয়ে ফেলা হচ্ছে।
দেশেও সেই ক্ষোভের আঁচ পড়েছে। রোববার সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক বিক্ষোভ সমাবেশের পর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ আজ মঙ্গলবার ঢাকায় ফরাসি দূতাবাস ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দিয়েছে।
এই দলের আমীর সৈয়দ রেজাউল করিম বলেন, তার এসব মন্তব্যের জন্য প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোকে মুসলমানদের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে, এবং বাংলাদেশ সরকারকে সংসদে প্রস্তাব এনে ফ্রান্সের নিন্দা করতে হবে।
তিনি বলেন, “ফ্রান্সে মুসলমানদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চলছে, মুহাম্মদ (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে। মুহাম্মদ (সা.)-কে অপমান করা হচ্ছে। আমরা চুপ করে বসে থাকতে পারি না।“
এর আগে, রোববার সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। সংবাদমাধ্যম ও সোশাল মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, সেখানে নানা মত-পথের ছাত্র সংগঠনের অংশগ্রহণ ছিল। সমাবেশে ফরাসি প্রেসিডেন্টের নিন্দা করা হয়েছে যে তিনি মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে ইসলাম বিদ্বেষকে উস্কে দিচ্ছেন।
ফ্রান্সের ইমেজে কি আঘাত পড়বে?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মুহাম্মদ (সা.)-এর কার্টুন নিয়ে নতুন এই বিতর্ক এবং ইসলাম নিয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্টের মন্তব্য-বিবৃতির প্রতিক্রিয়া কতদূর গড়াতে পারে বাংলাদেশে?
সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে উদার ও অগ্রসর দেশ হিসাবে ফ্রান্সের যে ভাবমূর্তি বাংলাদেশে রয়েছে তাতে কি বড় কোন আঘাত পড়বে?
নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক ড. আব্দুর রব খান মনে করেন এই ক্ষোভ ‘সাময়িক।‘
তিনি বলেন, “ইসলাম নিয়ে বাংলাদেশে স্পর্শকাতরতা রয়েছে, ফ্রান্সে যা হচ্ছে তা নিয়ে হয়ত আগামী কিছুদিনে আরো বিচ্ছিন্নভাবে কিছু প্রতিবাদ দেখা যাবে – কিন্তু এ নিয়ে যে দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ হবে বা ফ্রান্স নিয়ে বাংলাদেশের জনমনে বড় কোনো বিরূপ মনোভাব জন্ম নেবে তা বলার সময় এখনো আসেনি।“
ড. খানের কথা, মুসলিম বিশ্বের কোথাও কোথাও যে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে তার সাথে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোকে নিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের কিছু আক্রমণাত্মক কথার সম্পর্ক রয়েছে।
এরদোগান দু’দিন আগে ফরাসি প্রেসিডেন্টকে ইসলাম এবং মুসলিম বিদ্বেষী বলে বর্ণনা করে মন্তব্য করেন যে “ম্যাক্রোর এখন মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন।“
ড. আব্দুর রব খানের মতে, এরদোগানের এসব বিবৃতির সাথে আন্তর্জাতিক কিছু ইস্যুতে ফ্রান্স এবং তুরস্কের ক্রমবর্ধমান রেষারেষির কিছু সম্পর্ক রয়েছে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেনও মনে করেন না যে মুহাম্মদ (সা.)-এর কার্টুন বিতর্ক এবং প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোর কিছু মন্তব্য নিয়ে বাংলাদেশে ফ্রান্সের ভাবমূর্তিতে বড় কোনো ধস নামবে।
তিনি এ প্রসঙ্গে ২০০৫ সালে ডেনমার্কের একটি পত্রিকায় নবীর কার্টুন ছাপার প্রসঙ্গ টানেন। তখনও বাংলাদেশে বিক্ষোভ হয়েছে, ডেনিশ পণ্য বর্জনের ডাক দেয়া হয়েছিল, সরকারের পক্ষ থেকে ডেনমার্কের সরকারে কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদও জানানো হয়েছিল।
তৌহিদ হোসেন বলেন, “তখনও সেগুলো ছিল তাৎক্ষণিক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এ নিয়ে ডেনমার্কের সাথে সম্পর্ক খারাপ বা ডেনমার্কের ভাবমূর্তি যে স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে গেছে তা হয়নি।“
তৌহিদ হোসেন বলেন, ফ্রান্স নিয়ে মুসলিম বিশ্বের কোথাও কোথাও নতুন করে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তার সাথে ‘সাংস্কৃতিক ভিন্নতা‘র একটি সম্পর্ক রয়েছে। “মুহাম্মদ (সা.)-এর কোনো অপমান মুসলিমদের কাছে খুবই স্পর্শকাতর বিষয়, কিন্তু ফরাসিরা মনে করে যে কোনো কিছু এবং যে কাউকে নিয়ে কথা বলার অধিকার তাদের রয়েছে।“
তবে, তৌহিদ হোসেনের মতে, মত প্রকাশের যে যুক্তি ফ্রান্স দেয় তার ভেতর অনেক স্ব-বিরোধিতা রয়েছে।
“নাৎসিদের সমর্থনে আপনি সেখানে কিছু বলতে পারবেন না, আইন করে তা নিষিদ্ধ। আর্মেনিয়ায় গণহত্যা অস্বীকার করা আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা কি তাতে থাকে?“
তুরস্ক-ফ্রান্স ‘পাওয়ার গেম‘
ফরাসি প্রেসিডেন্ট এবং তার সরকার নিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের মন্তব্য নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ফ্রান্স।
ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোববার বলেন, প্রেসিডেন্ট এরদোগান মুসলিম বিশ্বের ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ঘৃণা উস্কে দিচ্ছেন। ফ্রান্স তুরস্ক থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে এনেছে।
ড. আব্দুর রব খান মনে করেন, এরদোগান ফ্রান্স বা ফরাসি প্রেসিডেন্টকে নিয়ে যেসব বক্তব্য বিবৃতি দিচ্ছেন, তা সাথে সাথে এই দুই দেশের মধ্যে শুরু হওয়া ‘পাওয়ার গেমের‘ (ক্ষমতার রেষারেষি) সম্পর্ক রয়েছে।
পূর্ব ভূমধ্যসাগরে খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান নিয়ে তুরস্ক ও গ্রীসের মধ্যে যে রেষারেষি চলছে সেখানে ফ্রান্স সরাসরি গ্রীসকে সমর্থন যোগাচ্ছে।
লিবিয়ায় তুরস্কের সামরিক হস্তক্ষেপের তীব্র বিরোধিতাও করেছে ফ্রান্স। আজারবাইজান-আর্মেনিয়া সংঘাতে তুরস্কের ভূমিকার সমালোচনা করছেন প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রো — এগুলো এরদোগানের একবারেই পছন্দ নয়।
সেইসাথে, সৌদি আরব এবং মিসরকে হটিয়ে ইসলামী বিশ্বের নেতৃত্ব নেওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তুরস্কের মধ্যে, এবং অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করেন সে কারণে মুসলিমদের স্পর্শকাতরতা নিয়ে – তা ফিলিস্তিনি সঙ্কট, রোহিঙ্গা সমস্যা বা কাশ্মির সমস্যা হোক বা ফ্রান্সে মুসলিম বিদ্বেষ হোক- এরদোগান খুবই সোচ্চার।
কতদূর গড়াতে পারে?
তৌহিদ হোসেন মনে করেন, ফ্রান্স-বিরোধী মনোভাব বাংলাদেশ বা মুসলিম বিশ্বে কতটা শক্তভাবে দানা বাঁধবে বা দীর্ঘস্থায়ী হবে তা অনেকটাই নির্ভর করবে ওআইসি‘র মত মুসলিম দেশগুলোর বড় যেসব প্লাটফর্ম রয়েছে তাদের ভূমিকার ওপর।
তিনি বলেন, “তারা যদি এ বিষয়টি নিয়ে চর্চা শুরু করে, বিবৃতি দেয়- তাহলে হয়তো মুসলিম বিশ্বে আরো বেশি ফ্রান্স বিরোধী মনোভাব বিস্তার লাভ করতে পারে।“
তবে সৌদি আরব বা মিসর এরদোগানের সুরে সুর মেলাবেন – সে সম্ভাবনা এখন খুবই কম। তাদের কাছে ফ্রান্সের চেয়ে তুরস্কের এরদোগান সরকার এখন অনেক বড় শত্রু।
একইসাথে, অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, মুসলিম বিশ্বে তৈরি হওয়া অসন্তোষকে কতটা গুরুত্ব প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রো দেন বা ভবিষ্যতে তিনি কি বলেন বা করেন – তার ওপর ফ্রান্স নিয়ে মুসলিমদের প্রতিক্রিয়ার গতি-প্রকৃতি অনেকটাই নির্ভর করবে।
ফ্রান্সে গত পাঁচ বছরে একের পর সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। দু’শরও বেশি মানুষ মারা গেছে। ফলে, কট্টর ডানপন্থী দলগুলোর কাছে থেকে চাপে পড়েছেন ম্যাক্রো।
তৌহিদ হোসেন এবং আরো অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ইসলাম নিয়ে বা ইসলামি কট্টরপন্থা নিয়ে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রো যেসব স্পর্শকাতর কথাবার্তা বলছেন তার সাথে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সম্পর্ক রয়েছে।
সামনের বছর ফ্রান্সে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগে ম্যাক্রো দেখাতে চাইছেন তিনি কট্টর ইসলাম এবং সন্ত্রাস দমনে কঠোর হতে দ্বিধা করবেন না।
সূত্র : বিবিসি