ধর্ষকের কঠোর শাস্তি জরুরি

0

অতি পরিচিত এক ভয়ংকর শব্দের নাম ধর্ষণ। যেটি শোনামাত্রই চোখের পাতায় ভেসে ওঠে একটি নিষ্ঠুর বেদনাচিত্র। কান্না-বিষাদে ছেয়ে যাওয়া একটি পরিবার, একটি পৃথিবী। যে পৃথিবীর আলো বিষাক্ত, বাতাস বিষাক্ত। বিষাক্ত পৃথিবীর জলরাশিও। বিষে বিষে নীল হয়ে ওঠে ধর্ষিতার দুইচোখ। অতঃপর এই বিষেভরা জীবন থেকে মুক্তি পেতে সে হয়তো খুঁজে নেয় আরেকটি দুঃখভরা সিদ্ধান্ত আত্মহত্যা। আবিষ্কৃত হয় আরেকটি নতুন লাশ। দিন দিন এ লাশের মিছিল বড় থেকে বড় হচ্ছে। পৃথিবীতে এমন কোনো ভূখন্ড নেই যেখানে ধর্ষণের মতো নিন্দনীয় ঘটনা ঘটছে না।

দিন দিন ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। নারীরা আজ কোথাও নিরাপদ নয়। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, গৃহবধূ, এমনকি অবুঝ শিশুও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। সভ্যতার যেন মৃত্যু ঘটেছে। নতুবা মাত্র ৪ বছরের শিশুর সঙ্গে এমন পৈশাচিক নৃশংসতা হয় কী করে?

কিন্তু কেন? এর অনেক কারণ আছে। এই যেমন- তাকওয়াহীনতা, পরিবারের দ্বায়িত্বহীনতা, ইন্টারনেটে অশ্লীলতার ছড়াছড়ি। টিভি সিরিয়াল ও ফিল্মে ধর্ষণের প্রচারিত দৃশ্য। এইসব অনুষ্ঠানে সচেতনতার নামে ধর্ষণকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, দেখলে মনে হয় যেন ধর্ষককে হাতেকলমে ধর্ষণ শেখানো হচ্ছে। ওই সব অনুষ্ঠান নারীদের যতটা না উপকার করছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করছে। কেননা এসব অনুষ্ঠানের শেষের দিকে হয় নায়ক এসে ধর্ষকের হাত থেকে নায়িকাকে উদ্ধার করে, নতুবা পুলিশ ধর্ষককে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু বাস্তবে এর কিছুই হয় না। না নায়ক আসে, আর না পুলিশ। উপরন্তু ধর্ষকরা প্রশিক্ষণ পায় ধর্ষণের। তাই বিষয়টি নিয়ে ভাবা প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি।

ইসলামের অনুশাসন না মানাই ধর্ষণ প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ। ইসলামের একটি শাশ্বত বিধান হলো পর্দা। যা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই আবশ্যকীয়। কিন্তু তা আজ যথারীতি মানতে নারাজ আমাদের সমাজের অনেকে। কেউ কেউ আবার পর্দাপালনকে শুধু নারীর জন্যই নির্ধারিত মনে করেন। তাই ঢালাওভাবে বলে দেন ‘ধর্ষণের জন্য বেপর্দা নারীরাই দায়ী’। যদি তাই-ই হতো তাহলে চার বছরের শিশুটিকে কেন ধর্ষিত হতে হয়? আসলে এখানে যেই বিষয়টির অভাব তা হচ্ছে ইসলামের অনুশাসনকে না মানা। এই অনুশাসন যেমন অনেক নারী মানছে না, তেমনি মানছে না বহু পুরুষও। অথচ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে রাসুল! আপনি মুমিনদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে; এটিই তাদের জন্য পবিত্রতর (ব্যবস্থা)। তারা যা করে আল্লাহতায়ালা সে বিষয়ে ভালোভাবেই অবগত আছেন।’ (সুরা নুর, আয়াত : ৩০)

হাদিসে এসেছে, নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী স্থান (মুখ/জবান) ও দুই পায়ের মধ্যবর্তী স্থান (যৌনাঙ্গ) হেফাজত করবে, আমি নিজে তার জান্নাতের জিম্মাদারি নেব।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৪৭৪)

এখানে কোরআন ও হাদিসে যা বলা হয়েছে তা কিন্তু নারী-পুরুষ উভয়কেই বলা হয়েছে। তাহলে বেপর্দার জন্য শুধু নারীকেই কেন দোষারোপ করা হবে? কেন নারীকে একা পেলেই হামলে পড়বে ধর্ষকের দল। ছিন্নবিচ্ছিন্ন করবে তাকে। অথচ আল্লাহতায়ালা বলে দিয়েছেন- ‘তোমরা নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়ো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৯৫)

ধর্ষণ প্রবণতার আরেকটি কারণ হলো ইসলামের নির্ধারিত শাস্তি বাস্তবায়ন না করা। ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্ষণ একটি জঘন্য অপরাধ। ইসলামে এই অপরাধ নিকৃষ্ট কাজ ও হারাম হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটি প্রকাশ্য অশ্লীলতা ও অত্যন্ত মন্দ পথ’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৩২)।

ধর্ষণের মতো হীন কাজকে ইসলাম শুধু নিষেধ করেনি, বরং ধর্ষকের জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। আলকামা (রা.) তার পিতা ওয়াসেল (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী করিম (সা.)-এর যুগে, এক নারী নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে এক লোক কাপড় পেঁচিয়ে মেয়েটির চোখমুখ ঢেকে দেয় এবং জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। মেয়েটি চিৎকার দিলে ধর্ষক পালিয়ে যায়। ইতোমধ্যে দ্বিতীয় আরেক ব্যক্তি ওই পথে যাচ্ছিল। (কাপড় পেঁচানোর কারণে আসল ধর্ষককে স্পষ্ট দেখতে না পাওয়ায় মেয়েটি তাকেই ধর্ষক মনে করে।) এবং সেই দ্বিতীয় ব্যক্তির দিকে ইঙ্গিত করে বলতে থাকে, ওই লোক আমার সঙ্গে এরকম অপকর্ম করেছে। ততক্ষণে সেখানে একদল মুহাজির সাহাবা উপস্থিত হন। তাদেরকে বিষয়টি অবগত করলে তারা সেই সন্দেহভাজন দ্বিতীয় ব্যক্তিকে ধরে মেয়েটির কাছে নিয়ে আসে। মেয়েটি নিশ্চিত করে বলে, এই লোকই সেই ধর্ষক। তখন তাকে তারা রাসুল (সা.) এর কাছে নিয়ে যান। নবী করিম (সা.) সে ব্যক্তির ওপর ইসলামের বিধান জারি করার আদেশ দিলেন। তখন (পালিয়ে যাওয়া আসল) ধর্ষক দাঁড়িয়ে বলে ওঠেন- হে আল্লাহর রাসুল, আমি-ই তার সঙ্গে অপকর্ম করেছি, আমিই আসল ধর্ষক। (এই লোক নয়)। তখন নবী করিম (সা.) সেই নারীকে বলেন, ‘তুমি চলে যাও, আল্লাহ তোমার অপরাধ মাফ করে দিয়েছেন।’ এরপর তিনি ভুলভাবে ধরে আনা লোকটির সঙ্গে সুন্দর ও উত্তম ব্যবহার করেন। ধর্ষক ব্যক্তিটিকে শাস্তিদানের জন্য পাথর মেরে হত্যা করার নির্দেশ দেন।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৩৮, ৪৩৬৬)

ধর্ষকের শাস্তিটা যে ব্যভিচারের চেয়ে আলাদা তা এই হাদিসেই স্পষ্ট রয়েছে। কেননা ব্যভিচারে শাস্তি হয় উভয়ের। আর ধর্ষণের শাস্তি হয় শুধুই ধর্ষকের, ধর্ষিতার নয়। কিন্তু আমাদের সমাজে চলছে উল্টো নিয়ম। এখানে ধর্ষকের বদলে শাস্তি পেতে হয় ধর্ষিতাকে।

মাথা ন্যাড়া, একঘরে করে রাখা, চলতে ফিরতে টিটকারি করা, হেয় প্রতিপন্ন করা সবকিছুই অর্পিত হয় কেবল নির্যাতিতার ওপর। আর বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় ধর্ষকের দল। যদিও দুই-চারজন ধর্ষকের বিচার হয়, কিন্তু শাস্তি হয় না। এ যেন নির্যাতিতার মুখ বেঁধে দেওয়ার নামান্তর। ফলে এই লঘু শাস্তির কারণে সমাজে ধর্ষণের মতো এই অভিশাপের ছায়া গাঢ় থেকে আরও নিকষ হচ্ছে। যদি ইসলাম-নির্ধারিত শাস্তির বাস্তবায়ন হতো, তাহলে সমাজ থেকে এই অভিশাপ মুছে যেত বহু আগেই।

আসুন, নারীদের প্রতি বিদ্বেষ না রেখে, তাদের ইজ্জত ও মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে ইসলামের বিধান বাস্তবায়নে সচেষ্ট হই। তবেই সমাজ থেকে দূর হবে ধর্ষণের কালো ছায়া।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com