রোগীর সেবা-শুশ্রূষায় সওয়াব

0

রোগীর সেবা-শুশ্রূষা, দেখভাল করা ও সান্তনা দেওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে ইবাদত। এটি মহানবী (সা.)-এর গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। কোনো কোনো ইসলামি আইনজ্ঞ এটিকে ওয়াজিব বলেছেন। রোগীর সেবার মাধ্যমে সেবাকারীর ইমান ও সমাজের সম্প্রীতি বাড়ে। এ ছাড়া সেবা-প্রচেষ্টা ও সামগ্রিক সচেতনতার মাধ্যমে বড় ধরনের বিপর্যয় রোধ করা যায়।

সেবা রোগীর অধিকার

সেবা-শুশ্রূষা পাওয়া অসুস্থ ব্যক্তির অধিকার। সামর্থ্য ও সুযোগ থাকার পরও রোগীর প্রতি যদি অবহেলা করা হয়, তবে কিয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘এক মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের ছয়টি অধিকার…, যখন যে অসুস্থ হবে তার সেবা করো।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২১৬২)

অন্য হাদিসে মহানবী (সা.) বলেন, ‘মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের জন্য পাঁচটি অবশ্যকরণীয় রয়েছে…, রোগীর খোঁজ-খবর নেওয়া।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৫০৩০)

মহানবী (সা.) রোগীর সেবা-শুশ্রুষা করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে আহার করাও, রোগীর শুশ্রূষা করো এবং বন্দিদের মুক্ত করো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৩৭৩)

পরকালীন জবাবদিহির বিষয়ে রাসুল (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, ‘হে আদম সন্তান, আমি অসুস্থ ছিলাম, তুমি আমার সেবা করোনি। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক, আমি আপনার সেবা কীভাবে করব! আপনি তো জগৎগুলোর প্রতিপালক। আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল? তুমি তার সেবা করোনি। তুমি কি জানতে না তুমি যদি তার সেবা করতে, তবে তুমি তার কাছে আমাকে পেতে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৯)

একবার দেখে আসা যথেষ্ট নয়

‘রোগীর সেবা’ বিষয়ে হাদিসে ‘ইআদত’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যার অর্থ বারবার ফিরে আসা। শায়খ ইবনে উসাইমিন বলেন, ‘হাদিসে জিয়ারাত (সাক্ষাৎ) শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। কেননা, তা সুস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রোগীর ক্ষেত্রে ‘ইআদাত’ আনা হয়েছে যার অর্থ বারবার ফিরে আসা। কেননা, ‘রোগ কখনো দীর্ঘ হয় এবং ধারাবাহিক সেবার প্রয়োজন হয়।’ (আশ-শারহুল মুমাত্তা, হাদিস : ৫/২৩৬)

রোগীর সেবা মুস্তাহাব

বেশির ভাগ ইসলামি আইনজ্ঞের মতে, সাধারণভাবে রোগীর সেবা করা মুস্তাহাব পর্যায়ের সুন্নত। তবে কোনো কোনো ব্যক্তির জন্য তা ওয়াজিবের স্তরে চলে যায় (যখন তার ওপর রোগীর নির্ভরতা বেড়ে যায় এবং অনন্যোপায় হয়)। ইমাম বুখারি (রহ.)-সহ হাম্বলি মাজহাবের কোনো কোনো ফকিহ রোগীর সেবা করাকে ওয়াজিব বলেছেন।

ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, রোগীর সেবা করা ‘ওয়াজিবে কিফায়া’ (সামষ্টিক অবশ্যকরণীয়)। অর্থাৎ যখন ব্যক্তির ভরণ-পোষণের মতো এবং উপযুক্ত চিকিৎসা নিশ্চিত করার মতো কেউ থাকবে না, তখন সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর তার প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত করা আবশ্যক। এমন গুরুতর অবস্থায় সমাজ ও রাষ্ট্রের অবহেলায় কোনো রোগী কষ্ট পেলে, ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা মারা গেলে তার দায় সমাজ ও রাষ্ট্রের সবার ওপর বর্তাবে। (বিস্তারিত দেখুন : আল মাউসুআতুল ফিকহিয়্যা কুয়েতিয়্যা : ৩৫/৯ ও ৩৬/৩৭১)

রোগী দেখার শিষ্টাচার

মহানবী (সা.)-এর আমল ও নির্দেশনা থেকে অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া বা তাকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার কিছু শিষ্টাচার প্রমাণিত হয়, যা শুভাকাক্সক্ষী, সাধারণ সেবক ও চিকিৎসক সবাই অনুসরণ করতে পারেন। যেমন

১. রোগীর সুস্থতার জন্য দোয়া করা : রাসুল (সা.) সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)-কে দেখতে গিয়ে তিনবার দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি সাদকে সুস্থ করে দিন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৬৫৯)

২. রোগীর অবস্থা জানতে চাওয়া : রাসুল (সা.) কোনো রোগী দেখতে গেলে তিনি তার কাছে বসতেন এবং তার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইতেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) মৃত্যুশয্যায় শায়িত এক যুবককে দেখতে যান এবং বলেন, তোমার অবস্থা কেমন?…’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৯৮৩)

৩. রোগীর কোনো প্রয়োজন বা প্রত্যাশা জানতে চাওয়া : রোগীর কোনো জিনিসের প্রয়োজন বা চাহিদা আছে কি না তা জানতে চাওয়া এবং রোগীর জন্য ক্ষতিকর না হলে তা পূরণ করা সুন্নত। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, “রাসুল (সা.) এক ব্যক্তিকে দেখতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন তুমি কিছু চাও? তুমি ‘কাআক’ (খাবার জাতীয়) চাও? সে বলল, হ্যাঁ। তখন তারা রোগীর জন্য তা সংগ্রহ করল।” (মুসনাদে আবি ইয়ালা, হাদিস : ৪০১৬)

৪. রোগীর কাছ থেকে দোয়া চাওয়া : ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) তাকে বলেন, ‘যখন তুমি কোনো রোগীর কাছে যাবে, তাকে বলবে তোমার জন্য দোয়া করতে। কেননা, তার দোয়া ফেরেশতাদের দোয়ার মতো।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৪৪১)

৫. দোয়া পাঠ করা : আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) রোগী দেখে সাতবার এই দোয়া পাঠ করতেন (উচ্চারণ) ‘আসআলুল্লাহাল আজিম, রাব্বাল আরশিল আজিম, আই-ইয়াশফিয়াকা।’ (অর্থ) আমি মহান আল্লাহর কাছে, যিনি মহা আরশের প্রতিপালক তোমার সুস্থতা কামনা করছি।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২০৮৩)

৬. আরও কয়েকটি বিষয় : ইসলামি আইনজ্ঞরা আরও বলেন, রোগীর সঙ্গে সাক্ষাৎ দীর্ঘ করা উচিত নয়, যাতে তার কষ্ট হয়; চিকিৎসক কর্র্তৃক নির্ধারিত নিয়ম ও সময়সূচি মান্য করে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া, তাকে হতাশার পরিবর্তে আশান্বিত করা, রোগীর কষ্ট হয় এমন কথা ও কাজ পরিহার করা এমনকি সুগন্ধি ব্যবহারে রোগীর কষ্ট হলে, তাও পরিহারের নির্দেশ দেন তারা। এ ছাড়া এত বেশি দেখা-সাক্ষাৎ না করা, যাতে তার বিশ্রাম ও চিকিৎসা ব্যাহত হয়। (আল-মাউসুআতুল ফিকহিয়্যা আল-কুয়েতিয়্যা : ৩১/৭৭-৭৯)

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com