সাকিব, ফিরে আসুন মহাবিক্রমে
২৪ জুন ২০১৯। সাকিব আল হাসান খেলছিলেন বিশ্বকাপ, আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে। ২৯ রানে পাঁচ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি, ব্যাট হাতে ৫১ রান। ফিল্ডিংয়ে বাউন্ডারি ঠেকাতে পারেননি। তখন ধারাভাষ্যকার বলেছিলেন, সাকিব ইজ অফিশিয়ালি হিউম্যান। কাগজে-কলমে সাকিবও একজন মানুষ। আজকে আমরা বড় বেদনার সঙ্গে বুঝতে পারছি, সাকিব আল হাসান শুধু কাগজে-কলমেই একজন মানুষ নন, বাস্তবেও তিনি একজন মানুষ। তাঁরও ভুল হয় এবং এমন ভুল, যা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো কোটি কোটি মানুষকে স্তম্ভিত করে দেয়।
সাকিব আল হাসান ভুল করেছেন। তিন–তিনবার জুয়াড়ি বার্তা পাঠিয়েছে তাঁকে আর তিনি সেসবের জবাব দিয়েছেন; কিন্তু বিধি মেনে জানাননি বোর্ডকে, আইসিসিকে। আমরা জানি না, সাকিবের মনে কী ছিল। আমরা জানি, তিনি এই সব প্রলুব্ধকর প্রস্তাবকে পাত্তা দেওয়ার পাত্র নন। দেনওনি। হয়তো তাই এসবকে অগ্রাহ্য করেছিলেন, ভুলেও গিয়ে থাকতে পারেন। মোবাইল ফোনে আসা বার্তাকে কেই–বা পাত্তা দেয়! সাকিবের মতো মানুষ রোজ কত কত বার্তা পাবেন, সবটা তাঁর পক্ষে মনে রাখা সম্ভবও নয়। কিন্তু সাকিব তো ভীষণ বুদ্ধিমানও, তাঁর আইকিউ সাংঘাতিক, তাঁর মনের বল অতুলনীয় এবং তাঁর বিচক্ষণতাও অসাধারণ—তিনি কীভাবে এই বোকামিটা করে ফেললেন!
এই রকম ক্ষেত্রে যা হয়। ধরা যাক, আমি একটা রাস্তায় না গিয়ে আরেকটা বিকল্প পথে গেলাম আর গাড়িটা দুর্ঘটনায় পড়ল, তখন বারবার মনে হয়, ইশ্, কেন এই পথে গেলাম! না গেলেই তো এই বিপদ হতো না।
আমাদের কাছে বুধবার সকালটা এসেছিল অনেক আলো নিয়ে আর সাকিবের খবরটা জেনে পুরো দেশ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, দিনের সব আলো নিভে গিয়ে যেন গ্রহণ লেগেছিল। আমাদের বারবার মনে হচ্ছিল, আমরা কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি আর ঘুম ভেঙে গেলেই আমরা স্বস্তি ফিরে পাব। যাক, এটা তাহলে স্বপ্ন ছিল।
সাকিবের স্ত্রী উম্মে আহমেদ শিশির তাঁর ফেসবুকে যে বার্তাটা দিয়েছেন, সেটাই সবচেয়ে যথার্থ বলে মনে হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘কিংবদন্তিরা রাতারাতি কিংবদন্তি হন না। তাঁদেরকে যেতে হয় অনেক ঝড়ের ভেতর দিয়ে। অনেক চড়াই-উতরাইয়ের ভেতর দিয়ে। কঠিন সময় আসবে, সেসবকে কঠোর মনোবলের সঙ্গে বুকে টেনে নিতে হয় তাঁদের। আমরা সবাই জানি, সাকিব আল হাসান কী রকম একটা শক্ত মানুষ। একটা নতুন শুরুর সূচনা হলো। তিনি সর্বসময়ের চেয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসবেন অচিরেই। তাঁকে জখমের কারণে ক্রিকেট থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল এবং আমরা দেখেছি বিশ্বকাপে তিনি কী নিদারুণভাবেই না ফিরে এসেছিলেন। এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। আপনারা আমাদের যে ভালোবাসা এবং সমর্থন দেখিয়েছেন, তাতে আমরা অভিভূত। একটা জাতি হিসেবে আমাদের এই ঐক্যই তো দরকার।’ (ইংরেজি থেকে অনূদিত)
এই মুহূর্তে এটাই হওয়া উচিত সাকিব আল হাসানের মনোভাব। আমরা যে সাকিবকে চিনি, তাঁর পক্ষেই এই দুঃসময় অতিক্রম করে রাজার মতো ফিরে আসা সম্ভব। তবে তাঁর জন্য, অন্যদের জন্যও এটা একটা শিক্ষা। এই ধরনের ঘটনাকে অগ্রাহ্য করা যাবে না। বিধিতে যা আছে, তা মান্য করে চলতে হবে।
স্কুলপাঠ্য কবিতায় আছে:
‘একটুখানি ভুলের তরে অনেক বিপদ ঘটে,
ভুল করেছে যারা সবাই ভুক্তভোগী বটে।’
ভুল করলে ফলও ভোগ করতে হয়। সাকিব আল হাসান যা করেছেন, তা ভুল। সাংগঠনিক বিধির লঙ্ঘন। তবে ফৌজদারি অপরাধ নয়।
সাকিব আমাদের ছেলে। তিনি আমাদের দিয়েছেন বহু আনন্দের উপলক্ষ। বিশ্বসেরা একজন ক্রিকেটারকে আমাদের মধ্যে পাওয়ার গৌরব তিনি আমাদের দিয়েছেন। আমি কতবার লিখেছি, পৃথিবীর ১ নম্বর কথাটার মানে আমরা অনেক সময় উপলব্ধি করতে পারি না। এভারেস্ট যেমন পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ, সাকিব আল হাসান তেমনি পৃথিবীর ১ নম্বর অলরাউন্ডার। বাংলাদেশের কোন মানুষটা আর কোন ক্ষেত্রে পৃথিবীর ১ নম্বর হতে পেরেছে? সাকিবকে আমরা ভালোবাসি। সাকিবকে বিতর্ক পিছু ছাড়ে না, সেটাও যেমন সত্য, তেমনি সাকিবকে আমরা ধারণ করতে পারি না, সেটাও সত্য। সাকিব যেখানেই যান, সবাই তাঁকে ঘিরে ধরে, তাঁর সঙ্গে ছবি তুলতে চায়, তাঁর অটোগ্রাফ চায়। কিন্তু একটা মানুষ তো ক্লান্ত থাকতে পারেন, বিমর্ষ থাকতে পারেন, অসুস্থ থাকতে পারেন, বিরক্ত থাকতে পারেন—কথাটা কে কাকে বোঝাবে যে সব সময় হেসে হেসে সেলফির জন্য পোজ দেওয়া যায় না। এসব আমরা বুঝতে চাইনি। সাকিব কেন শুধু ফটো তুলতে দিয়েছেন, কেন ভিডিও করতে দেননি, এই নিয়েও আমরা মুণ্ডুপাত করেছি।
কিন্তু আজকে আমরা সবাই একবাক্যে সাকিবের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। আমরা জানি এবং মানি, আমাদের প্রিয়তম মানুষটা একটা ভুল করেছেন। তঁার শাস্তি তাঁকেই পেতে হচ্ছে, কিন্তু সেই ব্যথা আমাদের সবার প্রাণে বাজছে। আজকে বাংলাদেশে আর কেউ নেই সাকিববিরোধী। না, তাঁর ভুলের পক্ষে সাফাই গাওয়ার কথা হচ্ছে না, ভুল তো ভুলই; কিন্তু দেশের মানুষ আজকে এক সুরে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, আজকে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে বিজ্ঞাপনের ওই স্লোগানে মোটেও বাড়াবাড়ি ছিল না—বাংলাদেশের জান, বাংলাদেশের প্রাণ, সাকিব আল হাসান—এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, আহা, সাকিব, কী করলেন আপনি, মানুষের এই ভালোবাসার কথাটাও তো আপনাকে ভাবতে হতো!
কিন্তু একটা কথা আমাদের বুঝতে হবে, এই ছেলেগুলো এই রকম পরোয়াহীন হয় বলেই এই রকম খেলতে পারেন। একবার মাশরাফি বিন মুর্তজা মোটরবাইকে চড়ে নড়াইল গিয়েছিলেন। সবাই বিস্মিত, কী করেছেন তিনি, যদি একটা দুর্ঘটনা হতো! তখন ক্রীড়া সাংবাদিক উৎপল শুভ্র বলেছিলেন, এই রকম দুঃসাহসী না হলে ফাস্ট বোলার হবেন কী করে? সাকিব যদি উদ্ধত, বেপরোয়া না হবেন, তাহলে কী করে তিনি এক বলে ছক্কা খেয়ে পরের বলে বোল্ড করে দেবেন প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে? বেন স্টোকসকে প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠিয়ে স্যালুট দেবেন কীভাবে? ২০১৫ সালের ১৮ জুন ভারতের সঙ্গে ম্যাচে ধোনির সঙ্গে ধাক্কা লাগে মোস্তাফিজের। সেই ধোনিকে কীভাবে আউট করবেন? ক্রিকেটে জেতার জন্য লাগে জিগীষা, জয় ছিনিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা, একটা কিলার স্টিংক্টও লাগে; খুনে রোখ। এটা আপনার আমার মতো নরম-সরম লোকের কাজ না। দশজন ঘিরে ধরেছে আপনাকে, তারা আপনাকে বিদ্রূপ করছে, পৃথিবীর ১ নম্বর বোলার আপনাকে বল করছে, আপনি বোলারের মাথার ওপর দিয়ে বাউন্ডারি হাঁকালেন; সে কি নরম মানুষের কাজ?
হ্যাঁ। শচীন টেন্ডুলকার কিংবা মেসির মতো ভদ্রলোক খেলোয়াড়ও তো হন। নিশ্চয়ই হন, কিন্তু আমাদের সাকিব এই রকমই। এই রকম করেই তিনি যদি আমাদের ভালো ফল এনে দেন…দাগ থেকে যদি ভালো কিছু হয় তো দাগই…
সাকিবকে বলার দরকার নেই, তবু বলি, সাকিব, মনোবল হারাবেন না। পৃথিবীর প্রতিটি দিনই একটি নতুন দিন। প্রতিটি ঘটনা থেকেই আমরা শিখি। আপনি ঠেকে শিখলেন, আমরা দেখে শিখলাম। আপনি আবার ফিরে আসবেন, আপনি ভক্তদের ভালোবাসা নিয়ে কঠোর অনুশীলন সেরে ফিরে আসুন মাঠে এবং দেখিয়ে দিন, এ হলো সাকিব আল হাসান, নম্বর ওয়ান!
পাশাপাশি এটাও বলে রাখি, বিসিবির ভেতরে-বাইরে অনিয়ম–দুর্নীতি–অব্যবস্থা নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলছি এবং এর বিহিত চাইছি। সাকিবের নিষেধাজ্ঞার এই ডামাডোলের ভেতরে আমরা যেন ভুলে না যাই যে ক্রিকেট ও ক্রীড়াঙ্গনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা অভিযান আমাদের দাবি। ঘরোয়া লিগে ম্যাচের ফল আগে থেকে ঠিক করে রাখা যাবে না। আম্পায়ার কেনাবেচা চলবে না। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে আটক ব্যক্তি বিসিবিতে থাকতে পারেন না। যাঁরা এসব করেছেন, তাঁদের বিচার করতে হবে। ক্রীড়াঙ্গনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। সাকিব তিনটা হোয়াটসঅ্যাপ বার্তার কথা আইসিসিকে না বলে শাস্তি পাচ্ছেন আর ঘরোয়া ক্রিকেটে ফল আগে থেকে ঠিক করে রাখার অভিযোগগুলোর বিচার হবে না? এটা কোনো কথা!