তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার সব স্বপ্ন কেড়ে নিচ্ছে তাসনুভাদের

0

তাসনুভা দেশের স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কৈশরে বিয়ে হওয়া তাসনুভা একমাত্র ছেলে তৌকিরের ভবিষ্যৎ চিন্তায় মাদকাসক্ত স্বামীর সংসার ছেড়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে। ছেলেকে নিয়েই তার সংসার আর হাজারো স্বপ্ন। কিন্তু স্বপ্ন ভেঙে যেতে বসেছে ছেলের মোবাইল ফোন আসক্তির কারণে।

গত দু-তিন বছর থেকে তৌকিরের মোবাইল ফোন ছাড়া আর চলছে না। পাবজি ও ফ্রি ফায়ারসহ নানা ধরনের অনলাইন গেমে আসক্ত হয়ে এখন রাতদিন সে ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কারো সাথে কথা বলে না। ঠিকমতো গোসল করে না। খাবার খায় না। ঘরের বাইরে যেতে চায় না। কারো বাড়িতে যাওয়া বা মাঠে খেলতে যাওয়া তো ভুলে গেছে অনেক আগেই। মাধ্যমিক কোনোরকমে পাস করে সে কলেজে ভর্তির চেষ্টায় রয়েছে।

তাসনুভা ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তায় গেম আসক্তি বন্ধ করার জন্য মোবাইলটা নিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। এতে ফল হয় উল্টো। ছেলে মাকে ছেড়ে মাদকাসক্ত বাবার কাছে ফিরে যেতে রাজি তবুও মোবাইল বা গেম ছাড়তে রাজি নয়। এমন ঘটনা শুধু তাসনুভার পরিবারের নয় দেশের অধিকাংশ পরিবারের এখন এমনই চিত্র।

এখন ছোট্ট অবুঝ সন্তানকে মা-বাবা মোবাইল ফোনটা হাতে না দিলে সে আর খাবার খায় না। ছাত্রছাত্রীরা অনলাইন ক্লাসের নামে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে লেখাপড়ার পরিবর্তে নানা প্রকার গেমে আসক্ত হয়ে পড়ছে। সারারাত জেগে পাবজি ও ফ্রি ফায়ারসহ নানা ধরনের অনলাইন গেমে সময় কাটিয়ে দিচ্ছে।

তিন বছরের শিশু আবির থেকে অনার্স পড়ুয়া ২২ বছরের নাফিজ কেউ এর বাহিরে নয়। বেশি ছোটরা ফোন নিয়ে নানা ভিডিও দেখা ও ছোটখাটো গেমে সময় পার করলেও একটু বড়রা সবাই এসব অনলাইন গেম নিয়ে পড়ে আছে। অনেক পরিবার আবার বাড়ির ছোট সন্তান মোবাইল ফোনের খুঁটিনাটি সব বিষয় জানায় অনেক গর্ব অনুভব করেন। আর এ থেকেই শুরু হয় আসক্তি। এ নেশা মাদকের চাইতে আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তৌকির ছাড়াও এ বিষয়ে এই প্রতিবেদকের কথা হয় অনলাইন গেমে আসক্ত শতাধিক ছাত্রছাত্রীর সাথে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাবজি ও ফ্রি ফায়ার ছাড়াও দেশের কিশোর, তরুণ ও যুবকেরা ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যান, কল অব ডিউটি মোবাইল, কমব্যাট স্ট্রাইক গোসহ নানা নামের আরো কয়েকটি অনলাইন গেমে আসক্ত হচ্ছে। এসব গেমে গুগল অ্যাকাউন্ট বা ফেসবুক আইডি দিয়ে সাইন ইন করতে হয়। অনেকে গেস্ট আইডি থেকেও এই গেমে অংশ নেয়। ব্রোঞ্জ, সিলভার, গোল্ড, প্লাটিনাম, ডায়মন্ড, হিরোইক ও গ্র্যান্ড মাস্টার নামে এসব খেলায় বিভিন্ন ধাপ বা অবস্থান রয়েছে।

সহজে কেউ হিরোইক ও গ্র্যান্ড মাস্টার পর্যায়ে যেতে পারে না। গ্র্যান্ড মাস্টার পর্যায়ে কেউ যেতে পারলে তাকে এসব গেমের সফটওয়্যার তৈরি বা আরো উন্নত করতে বা খেলার জন্য তাদের নিয়ে যাবে বলে এসব তরুণেরা বিশ্বাস করে। ছাত্রজীবন শেষে কর্মজীবনে ব্যবসা বা চাকরির পাশাপাশি ক্যারিয়ার হিসেবে এসব গেমকে নেয়া যাবে বলেও তাদের বিশ্বাস। ইউটিউব চ্যানেল খুলে সেখানে এসব গেম ছেড়ে দিয়ে প্রচুর আয় করার স্বপ্নও দেখে এ সব তরুণ। চলমান করোনাকাল এসব গেম খেলোয়ারদের কাছে আশীর্বাদ স্বরূপ দেখা দিয়েছে।
বাবা-মার কাছ থেকে টাকা নিয়ে শুধু ইন্টারনেট কেনা নয় কিনছে খেলার জন্য ডায়মন্ড টপআপ (টাকা দিয়ে অনলাইনে খেলার বিভিন্ন সামগ্রী)। সন্তানকে ঘরে রাখতে করোনাকালে অনেক পরিবার বাড়িতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ নিয়ে ওয়াইফাই রাউটার বসিয়েছে। বাবা-মায়ের সামনে বসে অনলাইন গেমে অংশ নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করলেও অনেক অভিভাবক কিছুই বুঝতে পারছেন না।

নাটোরের মুদ্রণ শিল্প ব্যবসায়ী আব্দুল হান্নান মানিকসহ অনেক অভিভাবক বলেছেন, তাদের তথ্য-প্রযুক্তির যে জ্ঞান, সন্তানের জ্ঞান তার কয়েকগুণ বেশি। ফলে সন্তানদের তারা কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। সরকার এসব খারাপ গেম বন্ধ করে সন্তানদের জন্য কল্যাণকর কোনো গেম চালু বা অন্য কোনো ব্যবস্থা না করলে এ আসক্তি থেকে সন্তানকে দূরে রাখা তাদের নিজেদের পক্ষে সম্ভব নয়।

ব্লু হোয়াইল-এর মতো এসব গেম সরাসরি মৃত্যু না ঘটালেও সন্তানকে আসক্তির মাধম্যে ধাপে ধাপে তার জীবন ঠিকই নষ্ট করে দিচ্ছে। অভিভাবকরা ১৮ বছরের কম বয়সীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার বন্ধে সরকারের কাছে কঠোর আইন তৈরি ও তার প্রয়োগ করার দাবি জানিয়ে বলেন, তবেই এ সমস্যার অনেকটা সমাধান করা সম্ভব হবে।

এ বিষয়ে পাবনা মানসিক হাসপাতালের ব্রেইন, মানসিক ও মাদকাসক্ত রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মাসুদ রানা সরকার বলেছেন, ইন্টারনেটের এসব গেমে আসক্তি বহুবিধ মানসিক সমস্যা সৃষ্টির অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। এটা এক ধরনের মানসিক রোগ। ১২ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের এ আসক্তি বেশি। প্র্যাতাহিক, অ্যাকাডেমিক, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কে এদের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। এদের কোনো কিছু মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়। চিকিৎসা, ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষার পাশাপাশি বিশ্বের অন্য দেশের মতো আমাদের দেশেও ছাত্রছাত্রীদের মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারে কঠোর নিয়ম করে তার বাস্তবায়ন করতে পারলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।

তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন এবং জাতীয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও গবেষণা অ্যাকাডেমি (নেকটার) বগুড়ার অতিথি প্রশিক্ষক এএসএম, শামসুজ্জোহা কবীর বলেছেন, বর্তমান প্রজন্ম স্মার্টফোন আর অনলাইনভিত্তিক নানা গেমে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এখন ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রণ করলে অনেকেই ভিপিএন ব্যবহার করে বিভিন্ন সাইটে যায়। এসব ক্ষেত্রে শিশুর সাথে ভালো-মন্দ বুঝিয়ে বলার দায়িত্বটা তো অভিভাবকের। এখন ইন্টারনেটে প্যারেন্টাল কন্ট্রোলের মাধ্যমে শিশুর গেম খেলা নিয়ন্ত্রণের সুবিধা রয়েছে। অভিভাবকরা চাইলে সন্তানের জন্য স্মার্টফোন ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারণ করে দিতে পারেন। কখন কতটুকু সময় গেম খেলবে বা কোন গেম খেলবে, তা ঠিক করে দিতে পারেন। সন্তানকে মোবাইলে ও কম্পিউটারে বেশি সময় একা বসে থাকতে দেখলে সে কি করছে তার খোঁজখবর নিতে হবে। সন্তানকে কখনো বেশি সময়ের জন্য একা থাকতে দেয়া যাবে না এবং এসব গেমের কুফল সম্পর্কে জানাতে হবে। সন্তান ও পরিবারের অন্য কোনো সদস্য মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কি না, সেদিকে বিশেষ লক্ষ রাখতে হবে। কেউ যদি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়, তাকে সঙ্গ দিতে হবে। কোনো গেম সম্পর্কে সন্তানের কৌতূহল থেকে নেশায় পরিণত হতে পারে। পরিবারের সাথে সময় দিয়ে গেম থেকে সন্তানকে দূরে রাখতে পারেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিচালক ও মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল হক সুফী বলেছেন, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাচ্চারা পড়ালেখা বিমুখ হয়ে পড়েছে। ফলে এই সুযোগে ছাত্রছাত্রীসহ পরিবারের অনেকেই গেমসের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে। অনেকের আবার বাইরে যেতে না পারায় মেজাজ খিটখিটে হয়েছে। ফলে অভিভাবকরা নিষেধ করলেও তারা মানছে না বরং অবাধ্য হচ্ছে। এ জন্য বাচ্চাদের মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য পড়ালেখা, খেলাধুলাসহ নিয়মমাফিক রুটিন মেনে চলার তাগিদ দেন তিনি। সেইসাথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফের চালু হলে ছেলে মেয়েরা পড়ালেখাসহ আগের অবস্থানে ফিরে আসবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com