ইয়াবা আসক্তের শতকরা ৯০ ভাগ কিশোর-তরুণ

0

দেশে বর্তমানে বছরে মাদক সেবনে খরচ হয় প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট একাধিক সংস্থার দেয়া তথ্যে এ কথা জানা গেছে। এসব সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের কাছে মাদকাসক্তের সংখ্যা ও মাদকের পেছনে ব্যয় হওয়া অর্থের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী তাদের ধারণা, বর্তমানে দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় এক কোটি। এদের নেশার পেছনে বছরে খরচ হয় প্রায় এক লাখ কোটি টাকা।

মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা মানসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ড এবং জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্সের সদস্য অধ্যাপক ড. অরুপ রতন চৌধুরী জানান, একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির মাদক সেবনে বছরে খরচ হয় ৫৬ হাজার ৫৬০ টাকা থেকে ৯০ হাজার ৮০০ টাকা। সে হিসাবে ১ কোটি মাদকসেবীর পেছনে বছরে ব্যয় ৫৬ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা থেকে ৯০ হাজার ৮০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ইয়াবা আসার পর দেশে মাদকের বিস্তার ভয়াবহ আকারে বেড়ে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে বছরে শুধু ইয়াবা বিক্রি হয় ৪০ কোটির মতো। যার বাজারমূল্য প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। এই ইয়াবা সেবনকারীর মধ্যে ৪৩ শতাংশ নারী।


অরুপ রতন বলেন, সরকারি হিসাব অনুযায়ী মাদক ব্যবসায় জড়িত আছে ২০০ গডফাদার ও ১ লাখ ৬৫ হাজার বিক্রির নেটওয়ার্ক। এদের মাধ্যমে মাদক খাতে বছরে লেনদেন হয় ৬০ হাজার কোটি টাকা। আর বেশ কিছু সংস্থার তথ্যানুযায়ী অবৈধ মাদক আমদানিতে প্রতি বছর বিদেশে পাচার হচ্ছে ১০ হাজার কোটির টাকার বেশি।

এই চিকিৎসকের মতে, ইয়াবা আসক্তের শতকরা ৯০ ভাগ কিশোর-তরুণ। ৪৫ শতাংশ বেকার। ৬৫ শতাংশ আন্ডার গ্র্যাজুয়েট এবং উচ্চ শিক্ষিতের সংখ্যা ১৫ শতাংশ। এ ছাড়া ১৫ বছরের বেশি বয়সের মাদকসেবী আছে ৬৫.২৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৪৮ লাখ ৯৩ হাজার ৭৫০ জন তরুণ যুবকের প্রতি ১৭ জনে একজন মাদকাসক্ত।

বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসঙ্ঘের প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, বিত্তশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী ও শিশু-কিশোরদের প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসায় জড়িত। এদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ পুরুষ, ১৬ শতাংশ নারী।


অরুপ রতন ছাড়াও এ নিয়ে গত বছর তৎকালীন র্যাব মহাপরিচালক ও বর্তমান পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ জানিয়েছিলেন, ‘দেশে ৭০ থেকে ৮০ লাখ মানুষ নিয়মিত মাদক সেবন করছে। এতে বছরে ১ লাখ কোটি টাকা বিনা কারণে খরচ হচ্ছে।’ ১৬ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জ সোনালী স্বপ্ন অ্যাকাডেমির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে দেশে মাদকের ব্যাপকতা বুঝাতে গিয়ে তিনি এ কথা বলেন।

অপর দিকে ঢাকা আহ্থছানিয়া মিশনের পরিচালনায় বেসরকারি সংস্থা অ্যাডিকশন ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড কেয়ার (আমিক) এ নিয়ে একটি গবেষণা চালায়। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৭০ শতাংশই অভিভাবকের অর্থ খরচ করে মাদক কেনে। ৫৬ দশমিক এক শতাংশ ব্যক্তি বলেছে, নিজের উপার্জনের অর্থ মাদকের পেছনে ব্যয় করে। এ ছাড়া পরিবারের সম্পদ বিক্রি করে ২০ দশমিক ৭ শতাংশ এবং অন্যের টাকা চুরি করে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যক্তি মাদক কেনে এবং ১৪ দশমিক ২ শতাংশ ব্যক্তি আত্মীয়দের কাছ থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে মাদক কিনে থাকে।

বিষয়টি নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, এমনিতেই দেশে নানান অর্থনৈতিক সঙ্কট রয়েছে। যার কারণে বিভিন্নভাবে আমরা পিছিয়ে রয়েছি। তার মধ্যে মাদকের বিষয়টি খুবই উদ্বেগের। এতে যেমন আমাদের একটি শ্রেণী দিন দিন নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তেমনি অর্থনৈতিকভাবেও আমরা প্রতিদিন ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছি। তিনি বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণ করা গেলে মানুষের প্রাণ রক্ষার পাশাপাশি বিশাল অঙ্কের যে ব্যয় তা দিয়ে দেশের উন্নয়নে বড় ধরনের সহায়তা হতো।

এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) মো: মোসাদ্দেক হোসেন জানান, দেশে এখন পর্যন্ত ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজা, চোলাই মদ, দেশী মদ, বিদেশী মদ, বিয়ার, রেক্টিফাইড স্পিরিট, ডিনেচার্ড স্পিরিট, তাড়ি, প্যাথেড্রিন, মরফিনসহ ১৫ ধরনের মাদক উদ্ধার হয়েছে। তবে সংখ্যায় এত হলেও বাংলাদেশের মাদকসেবীরা সেবন করে ৬ থেকে ১০ ধরনের মাদক। সবচেয়ে ভয়াবহতা ইয়াবাকে ঘিরে। কারণ ইয়াবা বহনযোগ্য হওয়ায় তা সহজে পাওয়া যায়। তিনি বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে তাদের অভিযান অব্যাহত থাকায় মাদকের দৌরাত্ম্য কমলেও তা থেকে একেবারে মুক্ত হওয়া সম্ভব না। কারণ সারা বিশ্বে মাদক পাচারকরীরা সক্রিয়।

অভিযান শুরুর পর মাদক অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা উৎস বন্ধ করার চেষ্টা করছি। তবে দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ও মাদকের পেছনে ব্যয় ও অবৈধ মাদক আমদানিতে প্রতি বছর কত টাকা পাচার হচ্ছে এমন প্রশ্নে সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব তাদের কাছে নেই বলে জানান এই কর্মকর্তা।

বিরাজমান পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান, অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. জিয়া রহমান বলেন, আমাদের সমাজে যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রথা এবং মূল্যবোধগুলো ছিল, সেগুলো ভেঙে গেছে। এ ছাড়া হতাশা, বঞ্চনা, বিষাদ, পরীক্ষায় খারাপ ফল, প্রতিকূল পারিবারিক পরিবেশ, পারিবারিক মণ্ডলে মাদকের প্রভাব ও ধর্মীয় অনুভূতির অভাব, সহজ আনন্দ লাভের বাসনা ও মাদকের সহজলভ্যতা মাদকাসক্তির অন্যতম কারণ। এ ছাড়াও আগে যে পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিবিধানগুলো ছিল, সেগুলোও এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে। এসব নানা কারণে মানুষের মধ্যে নেশার আসক্তি বাড়ছে।

তিনি বলেন, অপরাধ সাধারণত দু’ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আইনের মাধ্যমে শাস্তির আওতায় এনে এবং পারিবারিক, সামাজিক ও নৈতিক কিংবা ধর্মীয় বিধিবিধানের মাধ্যমে। কিন্তু এখানে অনেক অপরাধী আইনের দুর্বলতার কারণে শাস্তির আওতায় আসছে না। সেই সাথে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ নিয়ন্ত্রণ করার যে চেকারগুলো ছিল সেই মাধ্যমগুলোও কাজ করছে না। এর বাইরে বড় বড় মাদক ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে মাদক সরবরাহের উৎসগুলো বন্ধ করা যাচ্ছে না। এসব নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণেই দিন দিন মাদকের বিস্তার বাড়ছে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com