তিস্তা সেতুর দরপত্রে ভয়াবহ জালিয়াতি

0

তিস্তা নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ প্রকল্পের টেন্ডারে ভয়াবহ জালিয়াতি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হলেও প্রকল্পের কাজই শুরু করা সম্ভব হয়নি। এমনকি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানি প্রকল্পের টেন্ডার সিকিউরিটি হিসেবে সাড়ে ৬ কোটি ও পারফরম্যান্স সিকিউরিটি (নিরাপত্তা অর্থ) হিসেবে প্রায় ৪০ কোটি টাকার ভুয়া ও জাল ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়েছে। বিষয়টি প্রমাণিত হলে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কৈফিয়ৎ তলব এবং টেন্ডার সিকিউরিটির অর্থ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু টেন্ডার ও পারফরম্যান্স সিকিউরিটি জাল এবং ভুয়া হওয়ায় তাও সম্ভব হয়নি। এতে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ক্ষতি হয়েছে সাড়ে ৬ কোটি টাকা।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার পাঁচপীর বাজার ও কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার মধ্যবর্তী স্থানে তিস্তা নদীর ওপর প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সেতু নির্মাণে প্রকল্প নেওয়া হয়। এ প্রকল্পের দরপত্রেই এমন জালিয়াতি ও অনিয়ম করা হয়, যা সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক অনুসন্ধানে উঠে আসে।

দুদক প্রধান কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান মিরাজ বিষয়টি অনুসন্ধান করেন। কমিশন তার দেওয়া প্রতিবেদন অনুমোদন দিলে গত রবিবার মামলা করা হয়। মামলায় ঠিকাদার আলী হায়দার রতন (৪৯), পিটিএসএল মৈত্রী প্রাইভেট লিমিটেডের এমডি মাহাবুবুর রহমান ও ওই প্রকল্পের সাবেক প্রকল্প পরিচালক খন্দকার মো. মাহবুব হোসেনকে (৫৬) আসামি করা হয়েছে।

অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট দুদক কর্মকর্তারা জানান, ৩৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে তিস্তা নদীতে সেতুটি নির্মাণে ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর দরপত্র আহ্বান করা হয়। ব্যয়ের মধ্যে জমি অধিগ্রহণে ১০ কোটি ৬৩ লাখ ও নদীশাসনে ৮৭ কোটি ৪৫ হাজার টাকা ধরা হয়। ৩১ টি স্প্যানসৃমদ্ধ সেতুটি ১ হাজার ৪৯০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৯ দশমিক ৬ মিটার প্রস্থ। সেতুর উভয় পাশে ৮২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ২৪ ফুট প্রস্থ সংযোগ সড়ক (কুড়িগ্রাম অংশে ৬ ও গাইবান্ধা অংশে ৭৬ কিলোমিটার) তৈরি করা হবে।

দরপত্র আহ্বানের পর পিটিএসএল মৈত্রী প্রাইভেট লিমিটেড এবং ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানির সমন্বয়ে গঠিত যৌথ মূলধনী (জেভি) কোম্পানি আবেদন দাখিল করে। তাদের দরপ্রস্তাব সর্বনিম্ন হওয়ায় কার্যাদেশটি তারা পায়। এরপর যৌথ কোম্পানি ২০১৮ সালের ১৯ এপ্রিল ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে টেন্ডার সিকিউরিটি হিসেবে সাড়ে ৬ কোটি টাকার চেক জমা দেয়। আর ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন তাদের অংশীদার পিটিএসএলের অনুকূলে ইউনিয়ন ব্যাংক পান্থপথ শাখার ব্যবস্থাপক এবং এক প্রিন্সিপাল অফিসারের স্বাক্ষরে একটি ব্যাংক গ্যারান্টি দেয়। ব্যাংক গ্যারান্টির সঠিকতা যাচাইয়ে ওইদিনই প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় থেকে ইস্যু করা ব্যাংকের (ইউনিয়ন ব্যাংক পান্থপথ শাখা) অধিযাচনপত্র পাঠানো হয়। এতে ব্যাংক গ্যারান্টি সঠিক মর্মে শাখা ব্যবস্থাপক আবুল কাশেম ও এক প্রিন্সিপাল অফিসার যুথী সুলতানা প্রত্যয়ন করেন। যা ছিল ভুয়া।

এরপর ২০১৮ সালের ১৮ জুন নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড ইস্যু করা হয় এবং শর্ত অনুযায়ী যৌথ মূলধনী কোম্পানি মনোনীত একজন প্রতিনিধির স্বাক্ষরে পারফরম্যান্স সিকিউরিটি হিসেবে ৩৯ কোটি ৮৭ লাখ ৪৭ হাজার ৭২ টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি ইউনিয়ন ব্যাংক পান্থপথ শাখা থেকে ইস্যু করা হয় ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশনের নামে। ব্যাংক গ্যারান্টির সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য ওই ব্যাংকে পাঠানো হলে এ ধরনের কিছুই তারা ইস্যু করেনি বলে জানায়। এতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের দাখিল করা পারফরম্যান্স সিকিউরিটি ভুয়া প্রমাণিত হলে প্রকল্প কর্র্তৃপক্ষ কৈফিয়ৎ তলব করে। একই সঙ্গে টেন্ডার সিকিউরিটি হিসেবে দেওয়া সাড়ে ৬ কোটি টাকা বিধি অনুযায়ী রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে নির্দেশ দেয়। পরে তদন্তেদেখা যায়, ইউনিয়ন ব্যাংক পান্থপথ শাখা থেকে টেন্ডার সিকিউরিটি হিসেবে জমা দেওয়া ব্যাংক গ্যারান্টি ভুয়া ছিল।

দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, মফিজুল ইসলাম নামে এক খণ্ডকালীন চাকরিজীবী প্রকল্প পরিচালকের কাছে ব্যাংক গ্যারান্টি নিয়ে যান। এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন পিটিএসএল মৈত্রী প্রা. লিমিটেডের এমডি মাহাবুবুর রহমান। ব্যাংক গ্যারান্টি সঠিক মর্মে তাদের প্রত্যয়নপত্র ইউনিয়ন ব্যাংক পান্থপথ শাখার ইন এবং আউট রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থানার চৌধুরীহাট চরপার্বতীপুর গ্রামের নূর ইসলামের ছেলে আলী হায়দার রতন ও ঢাকার পুরানা পল্টনের আব্দুল করিম হাওলাদারের ছেলে মো. মাহবুবুর রহমান এ জালিয়াতির আশ্রয় নেন।

টেন্ডার সিকিউরিটি হিসেবে জমা দেওয়া ব্যাংক গ্যারান্টির যাচাইয়ের চাহিদাপত্রটি প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় থেকে কীভাবে, কার মাধ্যমে ইউনিয়ন ব্যাংকের পান্থপথ শাখায় গেল এবং যাছাই প্রত্যয়নপত্রটি প্রকল্প পরিচালকের কাছে কীভাবে, কার মাধ্যমে ফেরত আসল সে বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক খন্দকার মো. মাহবুব হোসেন সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি। ফলে ঠিকাদার ও প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভুয়া ও জাল ব্যাংক গ্যারান্টি ইস্যুর মাধ্যমে সরকারের সাড়ে ৬ কোটি টাকা ক্ষতির প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া যায়। এ কারণে অনুসন্ধান কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে আলী হায়দার রতন, মাহাবুবুর রহমান ও খন্দকার মো. মাহবুব হোসেনকে আসামি করে মামলার সুপারিশ করেন। অনুমোদন দেওয়ার পর অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় (সজেকা) ঢাকা-১ এ মামলাটি করেন।

দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ ঠিকাদার ও প্রকল্প পরিচালকের যোগসাজশে জালিয়াতি হওয়ায় প্রকল্পের কাজ মারাত্মক বাধাগ্রস্ত হয়। দুই বছরের বেশি সময় পার হলেও প্রকল্পের কাজই শুরু করা যায়নি। এতে সরকারের বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। আর টেন্ডার সিকিউরিটি হিসেবে দেওয়া ব্যাংক গ্যারান্টি জাল হওয়ায় সরকারের প্রত্যক্ষভাবে সাড়ে ৬ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। তদন্তে এ জালিয়াতিতে আরও কেউ জড়িত থাকলে, তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।’

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com