টাকা পাচার ঠেকাতে বহুমুখী উদ্যোগ
আমদানি-রফতানির আড়ালে দেশ থেকে টাকা পাচার ঠেকাতে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পণ্য পরীক্ষায় সব বন্দরে বসানো হবে বিশেষ স্ক্যানার। রফতানি আয়ের যে অর্থ ফেরত আসে না তা আনার উদ্যোগ নেয়া হবে। আমদানির বিল পরিশোধের আগে যাচাই করা হবে পণ্যের আন্তর্জাতিক দর। বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশ থেকে আমদানি-রফতানির আড়ালে টাকা পাচারের পরিমাণ বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থার জরিপে বেরিয়ে এসেছে এমন তথ্য। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে আমদানি-রফতানির মাধ্যমে প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। বাস্তবে আরও অনেক বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে।
আগে দেশ থেকে হুন্ডি ও চোরাচালানের মাধ্যমে টাকা পাচার হলেও এখন হচ্ছে ব্যাংকিং চ্যানেলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তেও ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাচারের ঘটনা ধরা পড়েছে। বেশির ভাগ টাকাই পাচার হয়েছে আমদানি পণ্যের মূল্য বেশি দেখিয়ে। এছাড়া বেশি দামের পণ্যের এলসি খুলে কম দামের পণ্য এনে, আমদানির ঘোষণার চেয়ে কম পরিমাণে পণ্য এনে এবং কিছু ক্ষেত্রে একেবারেই পণ্য না এনে শুধু টাকা পাচার করা হয়েছে। ঠিক বিপরীতভাবে রফতানির মূল্য কম দেখিয়ে, ঘোষিত পরিমাণের চেয়ে বেশি পণ্য রফতানি করে, রফতানি মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে দেশে এনে এবং পণ্য একেবারেই দেশে না এনেও টাকা পাচার করা হয়েছে।
বাণিজ্যিক ব্যাংক ও এনবিআরের কাস্টমস বিভাগ এসব বিষয় তদারকি করে। তাদের যোগসাজশে নানা অনিয়মের মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে এবার টাকা পাচার ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর মাঠে নেমেছে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমদানি-রফতানির আড়ালে দেশ থেকে যে টাকা পাচার হচ্ছে সেগুলো বন্ধ করতে পারে ব্যাংক ও কাস্টম হাউস। তারা সতর্ক হলেই এক্ষেত্রে সুফল পাওয়া সম্ভব। আমদানির এলসি খোলা ও পণ্য দেশে আসার সময় ব্যাংক ও কাস্টমস কর্মকর্তারা এগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। তারা প্রচলিত নিয়ম-কানুন মেনে চললে পাচার ঠেকানো সম্ভব।
সূত্র জানায়, আমদানি পণ্যের মূল্য এলসিতে যা লেখা হচ্ছে বিল পরিশোধের সময় তা যাচাই করবে ব্যাংক। এর মাধ্যমে পণ্যের মূল্যের চেয়ে বেশি অর্থ বিদেশে পাঠানো ঠেকানো যাবে। এলসির ঘোষণা অনুযায়ী পণ্য দেশে আসছে কিনা, সে বিষয়টি তদারকি করবে কাস্টমস। প্রয়োজনবোধে ব্যাংক ও কাস্টমস সমন্বয় করে এসব বিষয় তদারকি করবে।
এ প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত বলেন, নানা কারণে রফতানি আয় অপ্রত্যাবাসিত থাকে। ব্যাংক সেগুলো নিয়মিত তদারকি করে ফিরিয়ে আনতে পারে। সে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর ফলে অপ্রত্যাবাসিত রফতানির মূল্য কমে যাবে বলে তিনি আশাবাদী।
পণ্য কনটেইনারে ভরে খালাসের সময় নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে এক পণ্যের কথা বলে অন্য পণ্য আমদানি ঠেকাতে ঢাকা কস্টমস ও বিমানবন্দরে ব্যবহারের জন্য এ মাসেই ৪টি ব্যাগেজ স্ক্যনার আনা হচ্ছে। এগুলোর মাধ্যমে বিশেষ করে লাগেজ বা ব্যাগে করে যেসব উঁচু মানের পণ্য আমদানি করা হয় সেগুলো স্ক্যান করা হবে। স্বর্ণ, তথ্যপ্রযুক্তি পণ্যসহ বেশি দামের পণ্যগুলো এসব স্ক্যানার দিয়ে যাচাই করা হবে।
অন্যান্য বন্দরে ব্যবহারের জন্য আরও ১৪টি ভেহিক্যাল স্ক্যানার আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এগুলো আমদানি করতে অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাবে ইতিমধ্যে অর্থমন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়া গেছে। এখন কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ বছরের মধ্যেই কেনা হবে। অন্যান্য স্ক্যানার কেনার কার্যক্রম চলছে।
এনবিআর সূত্র জানায়, বন্দরে স্ক্যানার বসলে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানি যেমন বন্ধ হবে, তেমনি বন্ধ হবে এর মাধ্যমে অর্থ পাচার। একইভাবে রফতানি পণ্য বন্দরে প্রবেশের ক্ষেত্রে স্ক্যানার দিয়ে যাচাই করা হবে। মিলিয়ে দেখা হবে এলসির সঙ্গে। ফলে পরিমাণে বেশি বা এক পণ্যের নামে অন্য পণ্য রফতানি বন্ধ হবে।
এ বিষয়ে এনবিআর’র শুল্ক নিরীক্ষা ও আধুনিকায়নের সদস্য খন্দকার আমিনুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনতে আগামী দেড় বছরের মধ্যে দেশের সব কাস্টম হাউস, বিমানবন্দর, স্থলবন্দরে স্ক্যানার বসানো হবে। বিমানবন্দরে ব্যাগেজ স্ক্যানারের পাশাপাশি সিটিস্ক্যানার থাকবে। কাস্টম হাউসের পাশাপাশি প্রতিটি স্থলবন্দরে ভেহিক্যাল স্ক্যানার ও কনটেইনার স্ক্যানার বসবে। ইতিমধ্যেই চট্টগ্রাম কাস্টমসে ১২টি গেটের মধ্যে ৬টি গেটে এবং রফতানির ৩টি গেটের মধ্যে ১টি গেটে স্ক্যানার বসানো হয়েছে।