আড়ালের গডফাদার কারা ?
বিতর্কিত সংসদ সদস্য শহীদ ইসলাম পাপুল, স্বাস্থ্য খাতে ভয়াবহ সিন্ডিকেটের প্রধান মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু, রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মহা প্রতারক শাহেদ করিম এবং জেকেজি হেলথ কেয়ারের বিতর্কিত ডা. সাবরিনা ও তার স্বামী আরিফ চৌধুরী কী করে নানামুখী অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছেন, কারা তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন, তা নিয়ে সব মহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্ট নাগরিকেরাও। প্রশ্ন উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আড়ালের গডফাদারদের চিহ্নিত করে তাদের মুখোশ উন্মোচন করার দাবি তুলেছেন সবাই। বিশিষ্টজনেরা বলেন, এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে মূলে আঘাত করতে হবে। বিচারের আওতায় আনতে হবে গডফাদারদেরও। জানা গেছে, পাপুল ও তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি হয়েছেন আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে। সরকারে প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশও রয়েছে এতে। পাপুলকে সমর্থন দেওয়ার জন্য লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগকে চিঠি পাঠানো হয়েছিল দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি থেকে। একই সময় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান মহাজোট প্রার্থী জাতীয় পার্টির নোমান মিয়া। আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহায়তায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে ভোটে জেতেন পাপুল। নিজে এমপি হয়ে থেমে থাকেননি, প্রভাব খাটিয়ে স্ত্রীকেও সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য করেছেন। প্রশ্ন উঠেছে, কোথায় পাপুলের ক্ষমতার উৎস? পেছন থেকে কে নেড়েছেন কলকাঠি? এদিকে রিজেন্টের বিতর্কিত সাহেদকে নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা। সাহেদ ঢাকার বাইরে গিয়ে পুলিশ প্রটোকল নিতেন। তার এক কর্মী চাকরি ছেড়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার পর দূতাবাসের সহায়তায় তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে হয়রানি করেছেন বলেও অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। যথারীতি ব্যবসা করেছেন মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্সধারী দুটি হাসপাতাল ও একটি হোটেল থেকে। অবৈধ হাসাপাতালে করোনা চিকিৎসা দিতে আবার চুক্তিও করেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে। তার এই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে শুধু স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজি নয়, উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে এলজিআরডি সচিবসহ আরও অনেক প্রভাবশালী আমলাকেও। রাষ্ট্রীয় সব অনুষ্ঠানে সাহেদকে নিয়মিত দেখা যেত। প্রতারণাসহ ৩২ মামলার আসামি সাহেদ আওয়ামী লীগের উপকমিটিতেই বা কীভাবে জায়গা পান, তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। সাহেদের এই বিশাল ক্ষমতার পেছনের গডফাদারদের নাম প্রকাশেরও দাবি জানিয়েছেন অনেকে। প্রশ্ন উঠেছে, স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়া মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর এ বিশাল সাম্রাজ্য কীভাবে তৈরি হলো। ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে গত ১১ বছরে মিঠু হাতিয়ে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। মিঠু ২০০৯ সালে ‘বিন্দু’ হয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রবেশ করে এখন ‘মহাসমুদ্র’। সেজেছেন স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়া। দাবি উঠেছে মিঠুর আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদেরও মুখোশ উন্মোচন করার।
করোনাকালে আরেক বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জন ডা. সাবরিনা আরিফ ও তার স্বামী আরিফ চৌধুরী। দুজন মিলে গড়ে তুলেছেন জিকেজি হেলথ কেয়ার নামে করোনার ভুয়া রিপোর্ট তৈরির কারখানা। এক ল্যাপটপ থেকেই তারা দিয়েছেন করোনা টেস্টের ১৫ হাজার ৪৬০টি ভুয়া রিপোর্ট। ন্যূনতম একটি ট্রেড লাইসেন্স না থাকা সত্ত্বেও কী করে এই ভুয়া প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতর চুক্তি করল? কারা তাদের এই সুযোগ তৈরি করে দিলেন? কী কারণেই বা তাদের এমন সুযোগ দেওয়া হলো? এসব নিয়েও প্রশ্ন সব মহলে। সাম্প্রতিক সময়ের এই বিতর্কিত ঘটনাগুলোর আড়ালে থাকা গডফাদারদের বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, পাপুল, মিঠু, সাহেদ বা ডা. সাবরিনা-এরা কিন্তু নিজে নিজে গড়ে ওঠেনি। তাদের পেছনের শক্তি হিসেবে সব সময় কেউ না কেউ কাজ করেছেন। বর্তমানে নিশ্চয়ই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই কেউ পেছন থেকে এদের মদদ দিয়ে আসছেন। তাই শুধু তাদের বিচার করলেই চলবে না। এসব অপরাধের মূলোৎপাটন করতে হবে। আঘাত করতে হবে গোড়ায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, করোনাভাইরাস যেমন একটি শারীরিক ব্যাধি, তেমনি দুর্নীতিও একটি সামাজিক ব্যাধি। এখন যারাই ধরা পড়েছেন, তারা হচ্ছেন সেই ব্যাধির উপসর্গ। তারা কখনোই এসব অনিয়ম-দুর্নীতি একা একা করতে পারতেন না। তাদের পেছনে অবশ্যই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের শরীরে কোনো ব্যাধির উপসর্গ দেখা দিলে আমরা যেমন তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হই এবং নির্মূল হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসা করি, তেমনি সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি বিতর্কিত ঘটনার মতো সব ধরনের দুর্নীতির ঘটনায়ই শুধু চিহ্নিত অপরাধীদের বিচার করে বসে থাকলে হবে না, এদের পেছনে কারা আছেন, কারা তাদের মদদ দিয়েছেন, তাদেরও খুঁজে বের করতে হবে এবং বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বড় কয়েকটি বিতর্কিত ঘটনা আমাদের চিন্তিত করেছে। যারা এসব বিতর্কের সঙ্গে জড়িত, তাদের পেছনের শক্তি হিসেবে অবশ্যই কেউ না কেউ রয়েছেন। প্রভাবশালীরাই তাদের পেছন থেকে মদদ দিয়েছেন। তাই এসব অপরাধীকে বিচারের পাশাপাশি তাদের গডফাদারদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগে যারা অভিযুক্ত হন, যাদের ধরা হয়, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান শুধু তাদের নিয়েই তৎপর হয়। দুর্নীতির ক্ষেত্রে কান টানলে মাথা আসা উচিত। কিন্তু আমাদের জবাবদিহির জায়গাটা এমন একপর্যায়ে আছে, মাথা আসছে না। অর্থাৎ চুনোপুঁটি নিয়ে টানাটানি হয়। কিন্তু ঘটনার পেছনের রুই-কাতলাদের কিছুই হয় না।’ তিনি বলেন, ‘এর কারণ হচ্ছে, প্রভাবশালীদের যারা এসব অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের ক্ষেত্রে কোনো না কোনোভাবে, প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষ, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার একটা সূত্র পাওয়া যায়। এই যে রাজনৈতিক যোগসাজশ, এর সঙ্গে দুর্নীতির ক্ষেত্রে সমর্থন, পৃষ্ঠপোষকতা, অংশগ্রহণ ও সুরক্ষা যোগ হয়। প্রশাসনিক দিক থেকেও একই অবস্থা চলে আসছে। প্রশাসনও তাদের সুরক্ষা দেওয়ার পথ বেছে নেয়। দুর্নীতির মূল হোতা, সেই রাঘববোয়ালরা একটা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্যরে চেয়ে বেশি প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। শুধু যারা সামনে আছেন বা গ্রেফতার হচ্ছেন, তাদের বিচার করে বসে থাকলে হবে না। প্রতিটি ঘটনার গভীরে গেলেই কেবল দুর্নীতি-অনিয়ম রোধ করা সম্ভব।’