টাকা না দিলে নির্যাতন করতো আ’লীগের এমপি পাপুলের লোকজন

0

নির্মম নির্যাতন, দিনের পর দিন খাবার না দেয়া, অকথ্য প্রহার ছিল এমপি পাপুলের টর্চার শেলের নিত্যচিত্র। বিদেশ বিভূঁইয়ে এমন নির্যাতন সইতে না পেরে কত লোক যে সংজ্ঞা হারাতো তার ইয়ত্তা নেই। এমপি পাপুলের কাজ করতে না চাইলেই রুমে আটকে রেখে মারতো। অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতো। খাবার দিতো না। পরে ক্ষুধার যন্ত্রণায় আবার কাজ করতে চাইলে মাসে ৩’শ দিনার দিতে হতো পাপুলের লোকজনকে। আমাদেরকে মাসে ১৪০ দিনার বেতন দেয়ার কথা থাকলেও কুয়েতে এসে দেখি মাসে নব্বই দিনারও আয় হয় না। উল্টো প্রতিদিন পাপুলের লোকজনকে দশ দিনার করে দিতে হতো।

এভাবেই বলছিলেন কুয়েত ফিরত ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার শাহ আলম।

মুদ্রা ও মানব পাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে কুয়েতে  গ্রেপ্তার বাংলাদেশি এমপি  মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম পাপুলের বিরুদ্ধে কুয়েতি আদালতে সাক্ষী  দেয়া বাংলাদেশি প্রবাসীদের মধ্যে শাহ আলম অন্যতম।

এমপি পাপুলের অভিযোগের ব্যাপারে ১১ প্রবাসী বাংলাদেশির সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। ওই ১১ জনের সবাই পাপুলের বিরুদ্ধে মানব পাচারের অভিযোগ আনার পাশাপাশি প্রতিবছর ভিসা নবায়নের জন্য বাড়তি টাকা নেয়া, প্রতিদিন উপার্জনের একটি  অংশ নেয়ার অভিযোগ এনেছেন। সোমবার রাত তিনটায় কাতার এয়ার লাইন্সের একটি ফ্লাইটে তারা দেশে ফিরেছেন। কুয়েতের সিআইডি তাদের আটক করে এবং জবানবন্দি রেখে  দেশে পাঠিয়ে দেন ।
শাহ আলম বলেন, গত বছরে রোজার ঈদের পরেই আমাকে কুয়েতে নেয়া হয়। সাড়ে সাত লাখ টাকা ধারদেনা  করে টাঙ্গাইলের রাশেদ নামে একজনকে আমি টাকা দেই। রাশেদ পাপুলের কাছের লোক। আমাকে মাসিক বেতনের কথা বলে নেয়া হয়েছিলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে দখি উল্টো নির্যাতন। আমাকে কুয়েতের এয়ারপোর্টে ব্যাগ ও মালামাল টানার কাজ দেয়া হয়। এসব কাজ করলে কুয়েতিরা এক দুই দিনার দিতো। এতে প্রতিদিন তেরো, চৌদ্দ দিনার আয় হতো। কিন্তু পাপুলের লোকজনকে এখান থেকে প্রতিদিন দশ দিনার দেয়া লাগতো। পাপুলের কোম্পানি সুপারবাইজার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সামাদ ও কুমিল্লার মাহবুব এই দুইজন এসে প্রতিদিন আমাদের কাছ থেকে দিনার নিয়ে যেতো। যার কারণে সারাদিন কাজ করার পর থাকতো দুই দিনার কিংবা তিন দিনার। এসবের প্রতিবাদ করলেই তারা নির্যাতন  করতো , কাজ বন্ধ করে দিতো। পরে যখন আবার কাজের জন্য যেতাম তিন’শ দিনার দিয়ে কাজ করতে হতো। এ বলেই কাঁদতে থাকেন শাহ আলম। তার সাথে কথা বলে জানা যায়, পাপুলকে গ্রেপ্তারের দুই দিন পর ৮ জুন তাদেরকে আটক করে কুয়েতের সিআইডি। তিনি বলেন, সিআইডি যেদিন আমাদের আটক করতে আসে, সেই দিন তারা  আমাদের বলেছিলো তোদের যে টাকা ক্ষতি হয়েছে সেগুলো তুলে দিবো। এই বলে আমাদের ১২ জনকে তুলে নিয়ে যায়।

কোর্টে সাক্ষ্য দেয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, আমাদের তিনটি প্রশ্ন করা হয়েছিলো। আমাদের কাছ থেকে পাপুলের কোম্পানি টাকা নিয়েছে কিনা, তারপর এখানে শর্তমোতাবেক কাজ দিয়েছে কিনা এবং মাসিক বেতন দেয় কিনা। আমরা যা সত্য তা বলেছি। কোনো মিথ্যা কথা বলিনি। শাহ আলমের কাছে প্রশ্ন ছিলো, পাপুলের সঙ্গে কখনো তাদের দেখা হতো কিনা? তিনি বলেন, এয়ারপোর্টে প্রায়সময় দেখা হতো। কিন্তু তাকে সালাম দেয়া তার সঙ্গে কথা বলা সম্পূর্ণ নিষেধ ছিলো। এয়ারপোর্টে তাকে সালাম দিলেই চাকরি চলে যেতো। নির্যাতন করতো।

শাহআলম বলেন, এই লকডাউনের সময় চার মাস কাজ ছাড়া ছিলাম। আমাদের কেউ দেখতে আসেনি। খাবার দেয়নি। চার পাঁচ দিন না খেয়ে ছিলাম। যারা এমন অবস্থায় কখনো ছিলো না, তারা ক্ষুধার যন্ত্রনা কি বুঝবে না। পরে বাড়ি থেকে চল্লিশ হাজার টাকা নিয়ে জীবনটা কোনোরকম বাঁচিয়ে রেখেছি।

আরেক স্বাক্ষী নোয়াখালির চাটখিল উপজেলার  মো. সোহাগ বলেন, আমি দুই বছর আগে ফকিরাপুল পাপুুল সাহেবের অফিসে মনিরকে সাত লাখ টাকা দিয়ে কুয়েত যাই। আমাদেরকে ১২ঘন্টা কাজ ও ১৪০ দিনার বেতন দেয়ার কথা ছিলো। কিন্তু কুয়েত যাওয়ার পর ১৭ ঘন্টা কাজ করতে হয়েছে। আমি একটা মার্কেটে কাজ করেছি। সেখানে সবমিলেয়ে নব্বই থেকে এক’শ দিনার পেতাম। এর মধ্যে প্রতিদিন পাপুল সাহেবের কোম্পানির লোকজন এসে চার দিনার করে নিয়ে যেতো। টাকা না দিলে নির্যাতন করতো। এসবের প্রতিবাদ কেউ করতে পারতো না। এই লকডাউনের সময় আমাদেরকে কুয়েতের কাবাত মরভূমির একটি জায়গায় রাখা হয় যেখান থেকে আমাদেরকে সিআইডি ধরে নিয়ে যায়। পরে গত বৃহস্পতিবার আমাদের কোর্টে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে আমরা স্বাক্ষ্য দেই। আমাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয় কিভাবে, কত টাকা দিয়ে এসেছি, কি কাজ দেয়ার কথা ছিলো বা কি কাজ দিয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলাম আমরা। কুয়েতে কেমন জীবন ছিলো? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, জায়গা জমি বিক্রি করে সাত লাখ টাকা খরচ করে গিয়ে যে এমন অবস্থা হবে, কল্পনাও করিনি। তারপরও এতো টাকা খরচ করে আসছি তাই নির্যাতন সহ্য করেছি। কষ্ট করে টাকা উপার্জন করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কিছুই তো হলো না। এখন আমার কি হবে?

সিআইডি টাকা আদায় করে দেয়ার কথা বলে আটক করেছে। টাকা দিয়েছে কিনা? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের বিমানে তোলার সময় সিআইডি কাউকে আড়াই’শ দিনার কাউকে দুই’শ দিনার দিয়েছে। কিন্তু আমাদের দেয়ার কথা ছিলো ৭০০ দিনার।

নওগাঁ সদর উপজেলার আব্দুল আলিম। তিনিও পাপুলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আলিম ২০১৮ সালের আগষ্টে কুয়েতে যান পাপুলের কোম্পানির মাধ্যমে। তিনি বলেন, আমি মনিরকে সাত লাখ টাকা দিয়েছি। তখন তারা বলেছিলো ১৪০ দিনার বেতন দিবে। কিন্তু নিয়ে কাজ দিয়েছে মার্কেটে ক্লিনার হিসেবে। যেখানে আমাকে বেতন দিতো এক’শ দিনার। কাজ করতে হতো ১৬ ঘন্টা। যদি ভালো কাজের জন্য কোম্পানির অফিসে যেতাম তখন তারা নির্যাতন করতো। আমাকে দুই দিন নির্যাতন করেছে। টাঙ্গাইলের রাশেদসহ কুয়েতিদের দিয়ে আমাকে কয়েকদিন নির্যাতন করেছে। আবার দুই তিন’শ দিনার দিলে তারা ভালো জায়গায় কাজ দিতো। তিনি অভিযোগ করে বলেন, পাপুল ও রাশেদের এলাকার লোকজনকে ভালো জায়গায় কাজ দিতো। আর আমাদেরকে দিতো এসব জঘন্য জায়গায়। যেখানে ১২ ঘন্টার কথা বলে ১৬ ঘন্টা কাজ করাতো। বেতন দিতো খুবই কম। খেয়ে না খেয়ে জীবন কাটিয়েছি। কোর্টে গিয়ে আমরা এসবই বলেছি। মিথ্যা বলেনি। এই বিচার পাবো কিনা জানি না , সৃষ্টিকর্তা বিচার করলেই হয়।

কুয়েতের পুরাতন এয়াপোর্টে কাজ করেছেন আরেক প্রবাসী বাংলাদেশি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, পুরাতন এয়াপোর্টে এক বছর ধরে কাজ করি। প্রতিদিন আট দশ টাকা ইনকাম হতো। কিন্তু কোম্পানিকে দিতে হতো প্রতিদিন আট টাকা। যারা  পুরাতান নতুন এয়ারপোর্টে কাজ করে তাদের দিতে হয় দশ টাকা। এবার দশ টাকা বা আট টাকা ইনকাম হোক আর না হোক পুরো টাকা দিতে হয়। না দিলে আমাদের গায়ে হাত তুলে কোম্পানির লোকজন। তিনি বলেন , আমাদের বেশি বেতন ও কম সময় ডিউটির কথা বলে আনলেও আমাদের জীবন শেষ করে দিয়েছে তারা। শুধু তাই নয় প্রতিবছর ভিসা নবায়নের কথা বলেও টাকা নিতো প্রচুর।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com