করোনার সুযোগে মৌলভীবাজার কলেজের গাছ কেটে সাবাড়!

0

পাশেই বন বিভাগের অফিস। কিন্তু অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি কলেজ কর্তৃপক্ষ। করোনাকাল, ক্যাম্পাস পুরোপরি শিক্ষার্থী শূন্য। শিক্ষকরা জরুরি হলে অফিস করেন। তবে তারাও করোনা আতঙ্কে তটস্থ থাকেন, কতক্ষণে কাজ শেষ করে নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারবেন। ক্যাম্পাসটি প্রায় সময়ই খালি থাকে। ফলে সুযোগসন্ধানী চক্র যে যার মতো করে ক্যম্পাসটি ব্যবহার করছে। সাবাড় করছে পাহাড়ি-টিলায় অবস্থিত মৌলভীবাজার সরকারী কলেজের ফল-ফলাদি, গাছ-মাছ সবই।

অভিযোগ আছে কলেজ প্রশাসনের এসব কর্মে সায় আছে। কিন্তু প্রশ্ন ওঠেছে সব কর্মই কি বাইরের দুষ্ট চক্রের ইচ্ছায়? না-কী কলেজ প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ স্বার্থান্বেষী কারও ফায়দা আছে এতে? তদন্ত হলে নিশ্চিতভাবে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। সাম্প্রতিক সময়ে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর হচ্ছে- নানা ছুঁতোয় কলেজ ক্যাম্পাসের বয়সী সব বৃক্ষ কেটে সাবাড়ের আয়োজন। কিছু কাঠ দিয়ে অবশ্য কলেজ অডিটোরিয়ামে বেঞ্চ, টেবিল-চেয়ার বানানোর কাজ চলছে। সাংবাদিকসহ উৎসুক কেউ ঢুঁ মারলে বা প্রশ্ন তুললে সেই মহাযজ্ঞের দিকে ইশারা করা হয়। কিন্তু কলেজ প্রশাসনের একাধিক সূত্রের দাবি- কলেজে দরজা বা জানালার ফ্রেম পরিবর্তনের কোনো কাজ নেই। অথচ শতবর্ষী কাঁঠাল গাছসহ একাধিক পুরনো বৃক্ষের কাঠ দিয়ে দরজা-জানালার বিশেষ সাইজের ফ্রেম তৈরি করা হয়েছে। সাধারণত যে সাইজের ব্যবহার হয় বাসাবাড়ি বা দালানকোঠায়। ফ্রেমগুলো রোদে শুকানোর কাজটি অধ্যক্ষ নিজে তদারকি করেছেন এবং তা বাংলোতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। এগুলো তো সব অভিযোগ। আদতে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর সত্যতা কতটুকু? জানতে ফোন করা হয়েছিল মৌলভীবাজার সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. ফজলুল আলীকে। ‘বাপ্পি স্যার’ নামে সমধিক পরিচিত ড. আলী জবাবে মুঠোফোনে মানবজমিনকে বলেন ‘গাছগুলো বিদ্যুতের লাইনের উপর পড়ে যাচ্ছিলো, তাৎক্ষণিক কাটা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। তাছাড়া কয়েকটি গাছ মারাও যাছিলো। এ অবস্থায় কাটাতে বাধ্য হয়েছি। আর হঠাৎ কাটতে গিয়ে বন বিভাগ বা কারও সঙ্গেই কথা বলতে সময় পাইনি। অধ্যক্ষের কাছে প্রশ্ন ছিল- মোট ক’টি গাছ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলো? আর ক’টি মরে যাচ্ছিলো? তিনি লা জবাব। জানার চেষ্টা হয় যেসব গাছ কাটা হয়েছে তার আনুমানিক মূল্য কত হবে? গাছগুলো থেকে মোট কত ফুট ফার্নিচার তৈরির উপযোগী কাঠ আর কতটা জ্বালানি কাঠ পাওয়া গেছে? জবাবে তিনি নিজেকে অসুস্থ দাবি করে এ নিয়ে উপস্থিত মুহুর্তে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

বন বিভাগের বিস্ময়, শিক্ষকদের মুখে কুলুপ

এদিকে মৌলভীবাজার সরকারী কলেজ ক্যাম্পাসের প্রায় ৩ লাখ টাকার অধিক মূল্যমানের বয়সী বৃক্ষগুলো কর্তনে রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করেন জেলার সহকারী বন কর্মকর্তা আবু বক্কর সিদ্দিক। গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, বুঝলাম না, কলেজের এতোগুলো গাছ কাটা হলো, অথচ আমরা জানলামই না। অনুমতি নেয়া বা দেয়া দূরে থাক।
কলেজের শিক্ষকরা এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে কানাঘুষায় ব্যস্ত থাকলেও গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে তারা খুব একটা আগ্রহী হননি। যে দু’একজন তথ্য দিয়েছেন তারাও নাম প্রকাশে রাজি না। তবে তাদের সঙ্গে কথা বলে এটা অনুমেয় যে ওই গাছগুলো কর্তনে কেবল অধ্যক্ষ বা কলেজ প্রশানের কতিপয় ব্যক্তি বেনিফিশিয়ারি নন, পরোক্ষভাবে আরও অনেকের ফায়দা রয়েছে এতে। ফলে ঝামেলা এড়াতে এ নিয়ে মুখে কুলুপ আঁটাই শ্রেয় মনে করছেন তারা। তাদের সঙ্গে আলাপ এবং সরজমিন অনুসন্ধানে গাছগুলো কর্তনের চিহ্ন এবং কোথায় কাঠ প্রসেসিং হয়েছে তার চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে প্রথম চালানটি শহরের বেরিরপাড়স্থ প্রয়াত মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলীর বাড়ি সংলগ্ন স’মিলে প্রসেস হয়। সেখানে কাঠাল গাছসহ প্রথম কাটা গাছগুলো প্রসেস হয়েছে। তবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বা শেষ চালানটি আর বেরিরপাড় যায়নি। এগুলো প্রসেস হয়েছে বর্ষিজোড়া বা টিবি হাসপাতাল সড়কের একটি স’মিলে। পুরো প্রক্রিয়াতে এক ধরণের তাড়াহুড়া বা গোপনীয়তার চেষ্টা ছিল। বলাবলি আছে সাধারণ শিক্ষক তো নয়ই, বিভিন্ন কমিটিতে থাকা প্রভাবশালী শিক্ষক এমনকি অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠজনদের অনেকেই এ বিষয়ে অন্ধকারে রয়েছেন। অথচ সরকারী কলেজ পরিচালনা সংক্রান্ত কমন নীতি হচ্ছে- কলেজের যে কোনো বড় কাজে স্বতন্ত্র আলাদা কমিটি গঠিত হবে। সেই কমিটির সদস্যরা আলাপ-আলোচনা এবং পরামর্শে নির্ধারিত কাজটি সম্পন্ন করবেন। এ ক্ষেত্রে অধ্যক্ষের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নির্দেশনা থাকবে, কিন্তু তিনি একনায়ক বা একচ্ছত্রভাবে কোনো সিদ্ধান্ত কিংবা কর্ম সম্পাদন করবেন না। যদিও সার্বিকভাবে তিনি কলেজের প্রশাসনিক প্রধান।
দায়িত্বশীল সূত্র মতে, রমজানের শেষের দিকে কলেজ ক্যাম্পাসের গাড়ির গ্যারেজ সংলগ্ন, পশ্চিম দিকের ৩টি ও দক্ষিণ দিকের দু’টি বড় গাছ কাটা হয়। গাছগুলো ছিল আকাশি ও মেহগনি। তারও আগে অর্থাৎ করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পূর্বে মৌলভীবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক, পৌর মেয়রসহ স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত সিদ্ধান্তে কলেজের সামনের রাস্তার ফুটপাত বড় করা হয়। এ সময় ক্যাম্পাসের পুরাতন বাউন্ডারি ভেঙ্গে কিছু জায়গা ছাড়তে হয়। তখন ৪০-৫০ বছর বয়সী একটি কাঁঠাল গাছ এবং কড়ই, গর্জনসহ বেশ কিছু গাছ কাটা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রী হোস্টেলের উত্তর পাশের আরেকটি কাঁঠাল গাছও কেটে সরিয়ে নেয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com