ভারতের কৌশলগত ভুল, ভ্রান্তি ও দৃষ্টিভ্রম
ভারতীয় কৌশলবিদেরা সেই ব্রিটিশ সাম্রাজের কাছ থেকে তাদের দেশের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ভুল, ভ্রান্তি ও দৃষ্টিভ্রমে ভুগছেন। তাদের ভুল খোদ ভারত সম্পর্কে তাদের ধারণায়। তারা পরাশক্তিগুলোর কাছ থেকে কৌশলগত সমর্থন পাওয়া নিয়ে ভ্রান্তিতে আছে এবং চীনের দিকে তাকিয়ে তারা বিভ্রান্তি বা দৃষ্টিভ্রমের শিকার হয়।
লাদাখে গত তিন সপ্তাহ ধরে ভারত ও চীনের মধ্যকার সামরিক উত্তেজনা একটি কৌশলগত দোটানার কথা বলে, যা ভবিষ্যতে ভারতের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে।
লাদাখ অচলাবস্থা
চীন ও ভারতের মধ্যকার সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনা কেবল হিমালয়ের পাহাড়ি এলাকার জনশূন্য ভূমি নিয়ে কুৎসিত বিরোধ নয়। এটি এশিয়ার পরাশক্তিগুলোর ভূ-কৌশলগত দাবার বোর্ডে দাপাদাপি প্রকাশ করছে। বেশি কিছু ইস্যুতে ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়েছে চীন এবং এর ফলে নয়া দিল্লির ওপর চাপ প্রয়োগ করেছে বেইজিং।
প্রথমত, কোভিড-১৯ অতিমারি নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিরপেক্ষ তদন্ত আহ্বানে অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে যোগ দিয়েছে ভারত। গত ১৮ মে জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৭৩তম অধিবেশনে এ ঘটনা ঘটে।
দ্বিতীয়ত, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাত জাতি ভার্চুয়াল সভায় অংশ নেন। এটিকে বিবেচনা করা হচ্ছে বিশ্ব স্থাস্থ্য সংস্থায় তাইওয়ানের পূর্ণ সদস্য প্রাপ্তিতে মার্কিন প্রয়াস।
এই সভায় অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, ইসরাইল, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া অংশ নেয়। এসব দেশের সবাই যুক্তরাষ্ট্রের অ-ন্যাটো মিত্র। তারা সবসময় যুক্তরাষ্ট্রের সব দাবি মেনে নেয়।
এছাড়া তাইওয়ানের সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে সহযোগিতামূলক সম্পর্কও প্রতিষ্ঠা করেছ ভারত। চীন মনে করে, এটি হলো এক চীন নীতি থেকে ভারতের সরে যাওয়ার ইঙ্গিত।
ভারত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়াড্রিলেটারাল জোটে অংশগ্রহণ বাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মধ্যকার এই প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা জোট এই অঞ্চলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, স্বচ্ছতা ও উন্মুক্ততার আহ্বান জানায়। দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন কৌশলের প্রতি ভারতের গোপন সমর্থন রয়েছে বলে চীন সন্দেহ করছে।
চতুর্থত, গত মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকার ভারতে চীনা বিনিয়োগের ওপর বিধিনিষেধ জারি করেছেন। চীন এটাকে বৈষম্যমূলক ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়মের লঙ্ঘন হিসেবে অভিহিত করেছে।
পঞ্চমত, ভারত একেবারে শেষ সময়ে এশিয়া-প্যাসিফিক রিজিওন্যাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ থেকে সরে গেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও ভারতের মধ্যে আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তিটির উদ্যোক্তা চীন।
ষষ্টত, ভারতের কৌশলবিদেরা ভুল হিসাব কষে মনে করেছিল যে কোভিড-১৯-এর ফলে চীনের ক্ষতিতে ভারতের লাভ হবে। তারা মনে করেছিল যে বিপুলসংখ্যক আমেরিকান কোম্পানি চলে যাবে। বস্তুত, ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মাত্র ৫ ভাগ আমেরিকান কোম্পানি ভারতে এসেছে। আমেরিকান কোম্পানিগুলো ভারতে না এসে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও বা তাইওয়ানে চলে গেছে।
পরিশেষে বলা যায়, ওহান ও মামালাপুরমে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাথে অনানুষ্ঠানিক বৈঠককালে মোদি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেগুলো পূরণ করেননি।
নিজের অবস্থান নিয়ে ভারতের ভুল
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও চীনের তুলনায় সে অনেক পিছিয়ে আছে। চীনের জিডিপি যেখানে ১৪ ট্রিলিয়ন ডলার, সেখানে ভারতের মাত্র ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলার।
মনে রাখতে হবে, ১৯৬২ সালের যুদ্ধের সময় দুই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যখন একই সমতলে ছিল, তখনই ভারতকে শোচনীয়ভাবে হারিয়েছিল চীন।
যুক্তরাষ্ট্র প্রশ্নে ভ্রান্তি
ভারতীয় কৌশলবিদেরা যুক্তরাষ্ট্রকে অংশীদার ও মিত্র মনে করে। আর ২০১৪ সাল পর্যন্ত চীনকে তারা মনে করত প্রতিযোগী। কিন্তু ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে জয়শঙ্কর পররাষ্ট্রসচিব হওয়ার পর ভারত নাটকীয়ভাবে চীন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে ফেলে। ভারতীয় মিডিয়া চীনকে ভারতের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকে। তারা ২১ শতকে বিশ্বের বৃহত্তম দুটি গণতন্ত্রের অংশীদারিত্বের কথা ব্যাপকভাবে বলতে থাকে। তারপর ২০১৬ সাল থেকে তারা এশিয়ান ভূ-রাজনীতিতে চীনের বিরুদ্ধে প্রধান যুদ্ধংদেহী রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
ভারতীয় কৌশলবিদেরা বিশ্বাস করতে থাকে যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত অংশীদারিত্বের মাধ্যমে উপকৃত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নতি স্বীকার করছে। আবার দোকলামের মতো ঘটনায় দেখা গেছে, ভারতকে প্রয়োজনীয় সমর্থন দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র।
চীন প্রশ্নে দৃষ্টিভ্রম
চীনের ব্যাপারে ভারতীয় কৌশলবিদেরা দৃষ্টিভ্রমে ভুগে থাকে। অথচ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রযুক্তিগত, সামরিক ও কৌশলগত সামর্থ্যের দিক থেকে ভারতের চেয়ে চীন অনেক এগিয়ে। তবে তারা বিষয়টি স্বীকার করতে চায় না।
ভারতের আরেকটি সমস্যা হলো, প্রতিবেশীদের মধ্যে কেউ তাকে সমর্থন দিচ্ছে না। কিন্তু এই সহজ সত্য ভারতীয় কৌশলবিদেরা স্বীকারও করতে চান না।
ভারতীয় কৌশলবিদেরা ভুল, ভ্রান্তি ও দৃষ্টিভ্রমে ভুগছেন। চীনের সাথে কাজ করতে গিয়ে অতীতে তারা যেসব ভুল করেছে, তার পুনরাবৃত্তি ঘটালে লাদাখেও তারা আরেকটি বড় ধরনের কৌশলগত ক্ষতির মুখে পড়বে।