যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্সে বিক্ষোভ
আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মার্কিনি জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভে উত্তাল যুক্তরাষ্ট্র। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, এই বিক্ষোভ এখন বিশে^র অন্য দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। বিক্ষোভ হয়েছে বৃটেন, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি এবং স্পেনেও। ১২তম দিনের মতো যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ ও পুলিশি নৃশংসতার প্রতিবাদে হাজার হাজার মানুষ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন শনিবার। এখন পর্যন্ত রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ হয়েছে। এতে কয়েক লাখ মানুষ অংশ নিয়েছেন। ফলে হোয়াইট হাউজমুখি সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। বিক্ষোভ হয়েছে নিউ ইয়র্ক, শিকাগো ও সান ফ্রান্সিসকোতে।
জর্জ ফ্লয়েডের জন্মস্থান নর্থ ক্যারোলাইনাতে স্মরণসভা হয়েছে। এর আগে তার প্রতি জনগণ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি।
গত ২৫ শে মে মিনিয়াপোলিসে পুলিশি নির্যাতনে নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েড মারা যান। এর ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, একজন শে^তাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক চাউভিন তার হাঁটু দিয়ে সজোরে জর্জ ফ্লয়েডের গলা মাটির সঙ্গে চেপে ধরে আছেন প্রায় ৯ মিনিট। এ সময় নিশ^াস ছাড়ার জন্য কাকুতি জানান জর্জ ফ্লয়েড। কিন্তু পুলিশ সদস্যদের কোনো করুণা হয় নি। তাকে হাসপাতালে নেয়া হলে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। এ জন্য ডেরেক চাউভিনকে বরখাস্ত করে তার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। এতে জড়িত অন্য তিন পুলিশ সদস্যকেও বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধেও সহায়তা করার অভিযোগ আনা হয়েছে। এ হত্যার প্রতিবাদে অন্য দেশগুলোতেও বর্ণবাদ বিরোধী বিশাল বিক্ষোভ হয়েছে। বৃটেনে পার্লামেন্ট স্কয়ার বিক্ষুব্ধ মানুষে লোকারণ্য হয়ে ওঠে শনিবার। করোনা ভাইরাসের কারণে বড় সমাবেশ না করতে সরকারের আহ্বান উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ এই বিক্ষোভে অংশ নেন। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি, মেলবোর্ন এবং ব্রিজবেনের বড় বড় শহরে বিক্ষোভ হয়েছে। সেখানে আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয় তার প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয়েছে এই বিক্ষোভে। বিক্ষোভ হয়েছে ফ্রান্স, জার্মানি এবং স্পেনেও।
যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াশিংটন ডিসিতে বিক্ষুব্ধ মানুষের হাতে ছিল ‘ব্লাক লাইভস ম্যাটার’ লেখা প্লাকার্ড। তারা বিক্ষোভ করেছেন ক্যাপিটল বির্ল্ডি, লিঙ্কন মেমোরিয়াল এবং হোয়াইট হাউজের কাছে লাফায়েতে পার্কের বাইরে। মেয়র মুরিয়েল বোসার বিক্ষুব্ধ লোকজনকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, এই বিক্ষুব্ধ জনতা প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছে। এর আগে সোমবার ফেডারেল আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা বিক্ষুব্ধ লোকজনকে সরিয়ে দিতে একটি পার্কের ভিতর কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে, যাতে ওই পার্ক পরিষ্কার হয়ে গেলে ট্রাম্প একটি চার্চ পরিদর্শন করতে যেতে পারেন। এ সম্পর্কে ট্রাম্পকে লক্ষ্য করে মেয়র মিস মুরিয়েল বোসার বলেছেন, তিনি যদি ওয়াশিংটন ডিসি দখল করে নিতে পারেন, তাহলে তিনি অন্য যেকোনো রাজ্য দখল করতে পারেন। তখন আমরা কেউই নিরাপদ থাকবো না। আমাদের সেনাদের এভাবে ব্যবহার করা উচিত নয়। মার্কিন নাগরিকদের সরিয়ে দিতে তাদেরকে নির্দেশ দেয়া উচিত হবে না। মুরিয়েল বোসার শহর থেকে ফেডারেল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সব কর্মককর্তা এবং ন্যাশনাল গার্ডের সদস্যদের প্রত্যাহার করে নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। বলেছেন, তাদের উপস্থিতি অপ্রয়োজনীয়।
৩৫ বছর বয়সী বিক্ষোভকারী এরিক উড বলেছেন, আমি এখানে এসেছি। কারণ, আমি না এসে থাকতে পারি নি। যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন ধরে বর্ণবাদ চলছে। ৪৬ বছর বয়সী বিক্ষোভকারী ক্রিস্টাল বেলিঙ্গার বলেছেন, এই সময়ে তিনি এই আন্দোলন নিয়ে আশাবাদী। তার ভাষায়, এই বিক্ষোভ থেকে ভিন্ন কিছু অনুভব করছি। আমি আশা করছি সংহতি এবং সমতার বার্তা বেরিয়ে আসবে এ থেকে। নিউ ইয়র্কে বিক্ষুব্ধ জনতা ব্রুকলিন ব্রিজ অতিক্রম করে। সান ফ্রান্সিসকোতে কিছু সময়ের জন্য বিক্ষোভ স্তিমিত হয় গোল্ডেন গেট ব্রিজে। বিক্ষোভ হয়েছে আটলান্টা, ফিলাডেলফিয়াতেও। সেখানে ‘আমরা ন্যায়বিচার চাই, আমরা ভালবাসা চাই’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন বিক্ষুব্ধ জনতা।
ওয়াশিংটন থেকে বিবিসির সাংবাদিক হেলিয়ার চেউং বলছেন, সেখানকার বিক্ষোভে বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠীর মানুষ অংশ নিয়েছেন। পরিবারগুলো শিশু সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে বিক্ষোভ করছেন। গান বাজানো হয়েছে। খাদ্য, পানি এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার দেয়া হয়েছে। বিক্ষুব্ধ জনতা স্লোগান দিচ্ছিল ‘জর্জ ফ্লয়েড’ এবং ‘ব্রেন্না টেলর’ বলে। ব্রেন্না টেলর মার্চে পুলিশি হেফাজতে মারা যান। সারিনা লেক্রোং (২০) এবং গ্রেসি (১৬) দু’বোন প্রথমবারের মতো বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। তারা মনে করেন, এই জনক্ষোভ এবং দেশজুড়ে বিক্ষোভের ফলে পুলিশে সংস্কার আসবে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, রাজপথের বিক্ষুব্ধ জনতা যারাই এই আন্দোলনকে সমর্থন করছেন তাদের আহ্বান নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে, যাতে তারা দীর্ঘদিন ধরে চলমান ধারাবাহিক বর্ণবাদ ও অসমতার সমাধান করেন, যেন তারা পুলিশি নৃশংসতা থেকে স্বাস্থ্যখাতে দৃষ্টি দেন। যুক্তরাষ্ট্রে শে^তাঙ্গদের তুলনায় ৫ গুন বেশি কৃষ্ণাঙ্গকে জেল দেয়া হয়েছে। মাদক সংক্রান্ত অভিযোগে শাস্তি দেয়া হয়েছে ৬ গুন বেশি, যদিও মাদক ব্যবহারের সমান অধিকার রয়েছে। জাতীয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ডাটায় এসব কথা বলা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে শে^তাঙ্গ মায়েদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গ মায়েদের মৃত্যুহার দ্বিগুন। বৈষম্য রয়েছে স্কুল সিস্টেম, হাউজিং এবং অন্যান্য সরকারি সুযোগ সুবিধায়। ২০১৯ সালে পিউ রিসার্স সেন্টার একটি গবেষণা প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, প্রতি ১০ জন কৃষ্ণাঙ্গ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মধ্যে আট জনের বেশি বলেছেন, এখনও যুক্তরাষ্ট্রে দাসত্বের প্রভাব রয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের ওপর।