শাসকেরা পাপ করেছেন শাস্তি পাচ্ছেন শাসিতেরা

0

রাজা ইডিপাসের গল্প জানেন না এমন লোক আমার পাঠকদের মধ্যে আছেন তা ধারণা করি না। পৌরাণিক যুগের এই রাজা ছিলেন দয়ালু এবং প্রজাবৎসল। তার রাজ্যের মানুষ সুখী ছিল এবং রাজা ইডিপাসের নামে জয়ধ্বনি দিত।

এই ইডিপাসের রাজ্যে একবার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ শুরু হল। মানুষ দলে দলে অনাহারে মরতে লাগল। ইডিপাস বিস্মিত হলেন।

তিনি কোনোদিন কোনো অনাচার করেননি, প্রজাদের ওপর অত্যাচার করা দূরের কথা। তাহলে প্রকৃতি তার ওপর রুষ্ট হল কেন? তিনি তো সজ্ঞানে কোনো পাপ করেননি।

তিনি রাজদরবারে পণ্ডিতদের ডাকলেন এর কারণ জানার জন্য। তারা পাঁজিপুঁথি ঘেঁটে রাজাকে জানালেন, প্রকৃতি কেন তার ওপরে রুষ্ট হয়েছে, তার কারণ তারা জানতে পেরেছেন। কিন্তু রাজাকে সত্য জানাতে ভয় পাচ্ছেন।

রাজা তাদের অভয় দিলে পণ্ডিতেরা জানালেন, রাজার পাপেই প্রজাদের এই দুর্ভোগ। রাজার পাপটা কী? তার মায়ের সঙ্গে ব্যভিচার করেছেন। এমন মহাপাপের কথা রাজা ইডিপাস দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি।

খোঁজ নিয়ে জানলেন, তিনি যে রাজ্য দখল করে রাজা হয়েছেন, সে রাজ্যের রানী ছিলেন তার মা। তিনি রাজ্যটি দখল করার পর না জেনে নিজের মাকে বিয়ে করেছেন।

রাজা ইডিপাসের গল্প এ পর্যন্তই থাক। আমরা শুধু আমাদের আলোচনার উদাহরণ হিসেবে রাজা ইডিপাসের গল্পের এটুকু ব্যবহার করেছি।

পাঠকদের বলতে চেয়েছি, রাজা বা শাসকদের পাপ ও অপকর্মের ফলেই আধুনিক যুগেও শাসিত সমাজ বন্যা, দুর্ভিক্ষ, ভূমিকম্প, মহামারী ইত্যাদি দ্বারা শাস্তি পেয়ে থাকে। এখন যেমন বিশ্বত্রাস করোনা মহামারী বা কোভিড-১৯ দ্বারা সারা বিশ্ব আক্রান্ত।

সারা বিশ্ব এখন আর পৌরাণিক যুগের বিশাল ও অজানা মহাবিশ্ব নেই। বিজ্ঞানের দৌলতে বিশ্ব আজ গ্লোবাল ভিলেজ বা বিশ্বগ্রাম। বিশ্বায়ন ঘটেছে সারা পৃথিবীর রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে এবং একইসঙ্গে মহামারীতেও।

কোথায় কোন সুদূর চীনের এক অখ্যাত প্রদেশে করোনাভাইরাসের জন্ম, মাত্র ডিসেম্বর মাসে তার জন্মের খবর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে জানানো হয়েছিল, আর মার্চ মাসের মধ্যে তা সারা দুনিয়াকে গ্রাস করেছে।

হিটলারের ঝটিকা বাহিনীও যা করতে পারেনি, এমনকি আমেরিকার দূরপাল্লার মিসাইলের এতটা দ্রুতগতিতে বিশ্ব পরিক্রমার ক্ষমতা নেই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও রোজ একসঙ্গে এত সৈন্য ও মানুষের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া যায়নি।

প্রকৃতির এই ভয়াবহ মৃত্যু ছোবলকে কী করে ঠেকানো যাবে, বিজ্ঞানীরাও তা এখন পর্যন্ত নির্ধারণ করতে পারেননি। মানবতাবাদীরা বলছেন, এটা আমাদের শাসকদের অনাচার ও পাপের ফল।

বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে ট্রাম্প, চীনের প্রেসিডেন্ট, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী জনসন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের মতো মানবতাবিরোধী নেতাদের আবির্ভাব এবং মারণাস্ত্র নিয়ে তাদের প্রতিযোগিতামূলক অনাচার থেকেই এই সর্বনাশা ভাইরাসের জন্ম ও বিশ্ব মহামারীর আকার ধারণ।

এই সত্যটা বিশ্ববাসীর চোখে ঢাকা দেয়ার জন্যই এই ভাইরাসের উৎস নিয়ে নানারকম গালগল্প ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।

যে গল্পটি বাজারে বেশি চালু, তা হল এশিয়ার বহু দেশে, বিশেষ করে চীনে বাদুড় এবং প্যাঙ্গোলিন নামক প্রাণীর মাংস বাজারে বিক্রয় ও খাওয়া থেকে এই ভাইরাসের আবির্ভাব।

তাই যদি হবে, তাহলে ডিসেম্বর মাসের শেষে যখন চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেইজিং-শাখাকে একটি নতুন ভাইরাস দেখা দেয়ার কথা জানিয়ে দিয়েছিল, তখন সামরিক শক্তি ও বিজ্ঞানের শক্তিতে শক্তিমান আমেরিকা সেই খবরকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেনি কেন? প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কী করে বলেছিলেন, ‘এটা সামান্য ফ্লু, দু’দিনেই চলে যাবে।’

সুইডেনের এক বিজ্ঞানী বলেছেন, বাদুড় বা অনুরূপ প্রাণীদেহের ভেতর থেকে ভাইরাস জন্ম নিতে পারে, কিন্তু তাকে ঘাতক ভাইরাসে পরিণত করে বিশ্বকে ক্রমাগত দূষিত করা! এটা বিস্ময়কর যে, এই ভাইরাস আরও আগে বিশ্বে হামলা চালায়নি।

কী প্রমাণ আছে আমেরিকা, চীন প্রভৃতি দেশের ক্রমাগত নিউক্লিয়ার অস্ত্র ও জীবাণু যুদ্ধের অস্ত্র বানানোর প্রতিযোগিতা থেকে পরিবেশ ভয়ানকভাবে দূষণের ফলে এই ভাইরাসের জন্ম হয়নি? সুইডেনের বিজ্ঞানীর এই প্রশ্নের জবাব এখন পর্যন্ত কেউ দেননি।

বিশ্বের অধিকাংশ দেশে রোজ রোগাক্রান্তদের সংখ্যা ও তাদের মধ্যে মৃত্যুর হার অবিশ্বাস্যভাবে বাড়ছে। এই মহামারী সম্পর্কে সব দেশের সব খবর এখনও সঠিকভাবে প্রকাশ পাচ্ছে না। যেদিন প্রকাশ পাবে সেদিন মানুষ বিস্মিত হয়ে দেখবে তারা কী ভয়াবহ মৃত্যুর সমুদ্র পার হয়ে এসেছেন।

এরই মধ্যে একটি আশার কথা, বিশ্বময় বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরির কাজে দিনরাত্রি চেষ্টা চালাচ্ছেন।

চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়া দাবি জানিয়েছে, তারা এই ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক নয়, তাকে ঠেকিয়ে রাখার পন্থা আবিষ্কার করেছে।

জাপান দাবি করেছে তারা এই ভাইরাস রোগের চিকিৎসার একটা প্রাথমিক ওষুধ আবিষ্কার করেছে। পরীক্ষাগারের কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেলে তারা তা বাজারে ছাড়বে।

সবচেয়ে অবিশ্বাস্য সুসংবাদ, বাংলাদেশের একটি আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত ওষুধ প্রতিষ্ঠানও দাবি করেছে, তারা এই রোগের একটা ওষুধ আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছে। এই ওষুধ কোম্পানির নাম বীকন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি।

ওষুধ শিল্পে বাংলাদেশ কতটা এগিয়েছে, তার প্রমাণ ক্যান্সারের ওষুধ তৈরিতে বীকনের সাফল্য এবং সারা বিশ্বে তার বাজার সম্প্রসারণ। বীকনের মালিক এবাদুর রহমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের একজন জনপ্রিয় এমপি।

এই বীকন করোনাভাইরাসের এক ধরনের প্রতিষেধক তৈরিতে সক্ষম হয়েছে বলে জানা গেছে। ওষুধটি পরীক্ষাগারে আছে এবং স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাভের জন্য তাদের হাতে তুলে দেয়া হবে।

কেউ বলতে পারেন, ‘হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।’ আমি বলব, যখন জগৎজোড়া একটা সংকট চলছে, তখন এই সংকট মোকাবেলায় যে কোনো দেশের যে কোনো ছোট প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দিতে হবে।

কেউ জানে না, কখন কীভাবে কোভিড-১৯-এর প্রতিষেধক বেরিয়ে আসবে। তা যে বেরোবে তা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। কোভিড-১৯ আমাদের সমাজ-সভ্যতা সব কিছু পাল্টাবে। শুধু পাল্টাতে পারবে না মানবতা ও মনুষ্যত্বকে।

আমার কৈশোর কেটেছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে। তখন আমরা ব্রিটিশ শাসনাধীন। হঠাৎ মহামারী আকারে বাংলাদেশে দেখা দেয় ম্যালেরিয়া। দোকানে কিংবা গ্রামের সরকারি ডাক্তারের কাছে প্যারাসিটামল এবং কুইনাইন ট্যাবলেট পাওয়া যেত না।

সরকার যুদ্ধরত সেনাবাহিনীর জন্য দুটি ওষুধই বাজার থেকে তুলে নিয়েছিল। তখন এন্টিবায়োটিক ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। সবই ছিল সালসা জাতীয় ওষুধ। এই সময় আমাদের এলাকার কবিরাজেরা দল বেঁধে এগিয়ে এসেছিল ম্যালেরিয়ার পাচন তৈরিতে।

আমি তিন মাস রোগ শয্যায় শায়িত থেকে কবিরাজের দেয়া পাচন খেয়ে ম্যালেরিয়ামুক্ত হয়েছিলাম।

নিরাশা ও হতাশায় ভেঙে না পড়ে বাংলাদেশের মানুষ যদি হেকিমি, কবিরাজি ইত্যাদি দেশীয় ওষুধের সন্ধান করেন এবং আমাদের হেকিম ও কবিরাজ সাহেবরাও ঘরে বসে এই প্রতিবেষক তৈরির কথা ভাবেন এবং কোনো সামান্য প্রতিষেধকও তৈরি করতে পারেন, তা মানুষকে রোগমুক্ত করতে না পারলেও নিরাশামুক্ত করতে পারবে। আমি আরেকটি উদাহরণ দেই।

ত্রিশের দশকে সারা বাংলাদেশে ভয়াবহ কালাজ্বর (Black Fever) দেখা দেয়। অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তারেরা এর কোনো প্রতিষেধক দিতে পারেননি। এই সময় ব্রহ্মচারী নামের এক বাঙালি ডাক্তার একটি ওষুধ আবিষ্কার করেন।

তা ব্রহ্মচারীর ইনজেকশন নামে পরিচিত হয়। ব্যাপকভাবে সরকারি উদ্যোগে এই ব্রহ্মচারী ইনজেকশন দিয়ে বহু কালাজ্বর রোগীকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছিল।

অবশ্য বিশ্বব্যাপী বর্তমান করোনা দানবের সঙ্গে অতীতের ম্যালেরিয়া বা কালাজ্বর মহামারীর তুলনা করা চলে না। এটা ভয়ংকর মহাদানব। তবু এই দানব দমনের যুদ্ধে ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাকেও স্বাগত জানাতে হবে। শুধু লক্ষ রাখতে হবে দেশের কোয়াক ও হাতুড়ে ডাক্তারেরা যেন এর সুযোগ গ্রহণ করতে না পারে।

কোনো কোনো প্রকৃতি বিজ্ঞানীও আশার ক্ষীণ আলো দেখাচ্ছেন। বলেছেন, ইউরোপে উইন্টার শেষ হয়েছে। ব্রিটেনে এবং বহু দেশে গরম আবহাওয়া দেখা দিয়েছে। আশা করা যায়, এবার ইস্টার হলিডের পর করোনার করুণা হবে।

তারা পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে আপাতত বিদায় নেবেন। যে প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা আমাদের এই আশার বাণী শোনাচ্ছেন, তাদের মুখে ফুলচন্দন পড়ুক।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com