বিদ্বেষ ছড়ানো প্রগতির ফেরিওয়ালাদের মুখোশ খুলে দিলেন আরিফ আজাদ
‘যদি বেঁচে যাও এবারের মত
যদি কেটে যায় মৃত্যুর ভয়
জেনো রেখো বিজ্ঞান লড়েছে একা
কোন মন্দির-মসজিদ নয়’।
কিউট এই লাইন চারটে ক’দিন ধরে এখানে-ওখানে, বিশেষ করে নাস্তিকদের গ্রুপগুলোতে ঘুরতে ফিরতে দেখছি। বৈশ্বিক এই দূর্যোগেও নিজেদের মার্কেটিং আর বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজ থেকে বিরত থাকতে পারলো না বিজ্ঞান আর প্রগতির এসব ফেরিওয়ালারা (!)
তারা আমাকে-আপনাকে বুঝাতে চাচ্ছে যে, এবার যদি আমরা কোনোভাবে বেঁচে-বর্তে যেতে পারি, তাহলে আমাদের জেনে রাখা দরকার যে, মন্দির-মসজিদ কিংবা ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো আমাদের বাঁচায় নি। আমাদের বাঁচিয়েছে বিজ্ঞান। মানে কি? মানে হলো, আমরা যে অদৃশ্য সত্ত্বার ইবাদাত করি, তার আদতে কোন ক্ষমতা নেই আমাদের বাঁচিয়ে নেওয়ার। বিজ্ঞানই এখানে, এই মুহূর্তে আমাদের রক্ষাকর্তা। এটাই হলো তাদের বক্তব্যের সারকথা।
প্রথম কথা হলো, বিজ্ঞান আর ধর্মকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার এই অসাধুতা তাদের আজকের নতুন কাজ নয়। সেই বিজ্ঞানি টলেমি আর গ্যালিলিও’র যুগ থেকেই তারা এই কাজটা খুব সুচতুরতার সাথে করে আসছে। কোন দূর্যোগ আর দূর্ভোগ যদি জনজীবনে নেমে আসে, তখনই তারা বলে, ‘এই দ্যাখো! বলেছিলাম না তোমাদের আল্লাহ-ইশ্বর কোন কাজের না? শেষমেশ বিজ্ঞানেই উদ্ধার পেলে তো?’
আসলে, বিজ্ঞান কি উদ্ধার করে?
বিজ্ঞানের না আছে হাত, না আছে পা, আর না আছে চোখ। তাহলে, বিজ্ঞান কিভাবে উদ্ধার করবে? বিজ্ঞানের কি কোন শক্তি-সামর্থ্য আছে?
আদতে, বিজ্ঞান তো আলাদাভাবে একক কোন সত্ত্বা নয়। বিজ্ঞান মানে হলো বিশেষ জ্ঞান। কোন ঘটনার বা বিষয়ের পেছনের যে কার্যকারণ, তা উদ্ভাবন, জেনে নেওয়ার নামই হলো বিজ্ঞান। আর, এই কার্যকারণ কিংবা উদঘাটনের পেছনে যারা কাজ করে, তারা আমার-আপনার মতোন মানুষ। সুতরাং, মানুষের পরিশ্রম, জানার স্পৃহা, নতুনকে সামনে আনার অদম্য ইচ্ছার সম্মিলিত প্রয়াসের নাম হলো গিয়ে বিজ্ঞান। তাই, ‘বিজ্ঞান বাঁচায়’ ধারণাটা একটা ভুল ধারণা যা মূর্খতার নামান্তর।
তাহলে, বিজ্ঞান আসলে আলাদা বা একক কোন সত্ত্বা নয়। এর পেছনে কাজ করে একদল মানুষ। এখন, এই মানুষগুলোর সৃষ্টিকর্তা কে? নাস্তিকরা বলবে, মানুষের কোন সৃষ্টিকর্তা নেই। মানুষ হলো বিবর্তনের ফসল। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, তারা এই দূর্যোগে বসে যাদেরকে শোনাতে চাচ্ছে যে, ‘তোমাদের মসজিদ তোমাদের বাঁচায় নাই’, সেই মানুষগুলো কি আদৌ বিবর্তনে বিশ্বাস করে? করেনা। তারা যা বিশ্বাস করে তা হলো, মানুষের সৃষ্টিকর্তা হলো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা।
এই পৃথিবীর সমস্তকিছুকে তিনি মানুষের জন্য উপযোগি করে সৃষ্টি করেছেন যাতে মানুষ এখানে বাঁচতে পারে। বংশবিস্তার করতে পারে। জ্ঞান-বুদ্ধির মাধ্যমে নিজেদের উৎকর্ষতার প্রমাণ রেখে যেতে পারে। তাই, এই মানুষই যখন নিজের জ্ঞান-বুদ্ধির মাধ্যমে কোনোকিছুকে জয় করে, কিংবা আবিষ্কার করে, তা আসলে দিনশেষে আল্লাহর ক্ষমতারই বহিঃপ্রকাশ। কারণ, মানুষকে এই ক্ষমতা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালাই প্রদান করেছেন। আল্লাহর দেওয়া আলো-বাতাসেই মানুষের বেড়ে উঠা। আল্লাহর দেওয়া অক্সিজেনেই মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা পায়।
কিন্তু, নাস্তিকরা যেহেতু আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে চায় না, তাই তারা যখন কোনোকিছু করে বা অর্জন করে, তখন তাদের বস্তুবাদীয় ব্যাখ্যা দিয়ে বলে, ‘না, আমি যা করেছি বা পেয়েছি সব আমার যোগ্যতার ফল। এই ক্ষমতা আমাকে কেউ দেয় নি’। ঠিক এই একই দাবি, একই অহংকার করেছিলো কারুন। কুরআনে এসেছে, সে বলেছিলো, ‘নিশ্চয় এগুলো আমি পেয়েছি আমার জ্ঞানের বদৌলতে’ [আল কাসাস ৭৮]। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, জ্ঞানের এই অহংকার কিছু মানুষের আজকের নতুন কোন স্বভাব নয়। যুগ যুগান্তরে, আমাদের এদেশীয় নাস্তিকদের অস্তিত্বলাভেরও হাজার বছর আগে মানুষ কোনোকিছু করলে বা অর্জন করলে বলতো, ‘আরে! এগুলো তো আমি আমার জ্ঞান দিয়েই পেয়েছি। কেউ আমাকে দেয় নি’। কিন্তু, তার এই জ্ঞান যে হাওয়া থেকে আসেনি, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা প্রদান করেছেন, তা সে স্বীকার করতে নারাজ।
সুতরাং, আমাদের বিভ্রান্ত করার জন্যে বলার দরকার নেই যে, ‘মসজিদ তোমাদের বাঁচায় নাই, বিজ্ঞান বাঁচিয়েছে’। আমরা জানি, মানুষের যতো উৎকর্ষতা, জ্ঞান আর অর্জনের ঝুঁড়ি, তার পেছনে রয়েছে আমাদের রব প্রদত্ত ক্ষমতা।
দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞান যা নিয়ে কাজ করে, বা যা কিছু উদ্ভাবন করে, তার সবটাই প্রকৃতিতে বিদ্যমান। প্রকৃতির উপাদানকে বাইরে ঠেলে রেখে বিজ্ঞান কোনোভাবে কাজ করতে পারবেনা, সেটা মাইক্রোবায়োলোজির অতি ক্ষুদ্রকায় কোষের গাঠনিক ব্যাপার স্যাপার হোক, কিংবা মহাকাশের অতি বৃহদাকার নক্ষত্র। সবকিছুই দিনশেষে প্রকৃতির উপাদান। মানুষ এই উপাদান নিয়েই কাজ করে। আর, প্রকৃতিতে এই উপাদান সৃষ্টি করে রেখেছেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা। তাই, বিজ্ঞানকে ইশ্বর বানিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে খারিজ করে দেওয়ার মাঝে কোন আদর্শিকতা নেই, আছে ব্যবসায়িক আর প্রবৃত্তিপূজার ধান্ধা।
‘আল্লাহ তোমাদেরকে এবং তোমরা যা কিছু করো, সবকিছুকে সৃষ্টি করেছেন’। [আস-সাফফাতঃ ১৮৫]
তৃতীয় ব্যাপার হলো, মসজিদে কেউ রোগ সারানোর জন্যে যায় না। মসজিদে যায় আল্লাহর ইবাদাত করার জন্যে। রোগ হলে কি করতে হবে তার যথাযথ গাইডলাইন ইসলামে খুব সুন্দরভাবে দেওয়া আছে। তবে হ্যাঁ, আমরা যেহেতু বিশ্বাস করি যে, রোগ-শোক আল্লাহর সৃষ্টি, তাই আমরা তার কাছে প্রার্থনা করি যেন তিনি তার এই সৃষ্টির অকল্যাণ থেকে আমাদের বাঁচিয়ে তোলেন। তার আরেক কল্যাণকর সৃষ্টি (এটা হতে পারে ওষুধ, হতে পারে খাবার-দাবার, বিশ্রাম ইত্যাদি) দ্বারা আমাদের ওপর আরোপিত অকল্যাণকে মুছে দেন। আমরা তার এক সৃষ্টি থেকে বাঁচতে আরেক সৃষ্টির উসিলা গ্রহণ করি, এবং তার সাহায্য চাই। এটার সাথে মসজিদ আমাদের বাঁচানোর আর মেরে ফেলার তো কোন সম্পর্ক নেই।
চতুর্থ ব্যাপার হলো, এই দূর্যোগ কাটাতে যেসব চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে সবাই কিন্তু আপনাদের মতো অন্তর্জালীয় বিজ্ঞানী নয়। তাদের মধ্যে আল্লাহয় বিশ্বাসী, গডে বিশ্বাসী, ইশ্বরে বিশ্বাসী অনেকে আছেন। পার্থক্য হলো, তাদের কাজ নিয়ে যে আপনারা অন্তর্জালে এভাবে খিস্তিকেউড় করে বেড়ান, তা দেখার তাদের টাইম নাই। টাইম নাই আপনাদেরকেও গুনার।
পঞ্চম এবং সবশেষ ব্যাপার হলো, মসজিদ আমাদের বাঁচাতে পারলো না বিজ্ঞান বাঁচালো, সেই তর্ক বাদ দিয়ে, আপনারা যারা এতোদিন অনেক বড়াই করে বলতেন যে, আপনারা দুনিয়ার সবকিছু জেনে ফেলেছেন, কৃত্রিম প্রাণ আবিষ্কার করে স্রষ্টাকে জাদুঘরে পাঠিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করে ফেলেছেন, তারা এবার খাস করে একবার তাওবা করে ফেলুন। ক্ষুদ্রকায় একটা ভাইরাস, যাকে খালি চোখে দেখাই যায় না, সেই অদৃশ্য একটা জিনিস আপনাদের কেমন করে নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে, তা দেখেও যদি আপনাদের অহমিকার পারদ নিচে না নামে, তাহলে দুনিয়ার আর কোন জিনিসে আপনাদের লজ্জা শরম হবে? এবার তো পা দু’খানা মাটিতে রাখেন। ডক্টর মুহাম্মদ জাফর ইকবালের সাম্প্রতিক আর্টিকেলের এই অংশটুকু আপনাদের উৎসর্গ করে শেষ করি-
‘পৃথিবীর এই অহংকারী দাম্ভিক মানবজাতিকে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় পদানত করে ফেলেছে ক্ষুদ্র থেকেও ক্ষুদ্র একটি ভাইরাস। পৃথিবীতে তার অস্তিত্ব ছিলোনা। হঠাৎ করেই তার জন্ম হয়েছে। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে, অর্থে-বিত্তে, সম্পদে বলীয়ান হয়েও পৃথিবীর মানুষ তার সামনে অসহায়। এই ক্ষুদ্র থেকেও ক্ষুদ্র যে ভাইরাসটি প্রথম জন্ম নিয়েছিলো, সেটি যদি মানুষের মতো চিন্তা-ভাবনা করতে পারতো, তাহলে সে কী অট্টহাসি দিয়ে বলতো, ‘পৃথিবীর মানুষ, তোমার কী নিয়ে এতো অহংকার?’
আরিফ আজাদ