বাসে করোনা সংক্রমণঝুঁকি
করোনাভাইরাস আতঙ্কে রাজধানী ঢাকার সড়ক এখন প্রায় ফাঁকা। মানুষের ভিড় কমার সঙ্গে সঙ্গে কমেছে গণপরিবহনও। এর মাঝেও বাধ্য হয়ে অনেকেই বাসে চলাচল করছে। যেসব বাসের পরিবেশ কোনোভাবেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। গত কয়েক দিন রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাসে এমন চিত্র দেখা গেছে। একাধিক রুটের যাত্রীরাও জানিয়েছেন, করোনাসংক্রমণ ঠেকাতে বাসে কোনো জীবণুনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে না। বাসের বিকল্প বাহনও নেই তাদের। তাই করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েই এসব বাসে চড়তে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
গাবতলী থেকে নিউ মার্কেটগামী ঠিকানা পরিবহনের যাত্রী শফিকুল ইসলাম গত শনিবার জানান, দেশে গণপরিবহন চলাচলে কোনো নীতিমালা নেই। বাসের লোকজন ইচ্ছেমতো যাত্রী তোলে। যেখানে ইচ্ছে সেখানে নামিয়ে দেয়। করোনা আতঙ্কে সারাবিশ্বের লোকজন আতঙ্কিত হলেও ঢাকার চালক ও হেলপারদের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা ঠিকমতো বাস পরিষ্কার করে না। কখনো কখনো গাদাগাদি করেও যাত্রী বহন করছে। কোনো যাত্রী ইশারা দিলেই ব্রেক কষে তাকে তুলে নিচ্ছে। সিট না থাকলেও দাঁড়িয়ে যাত্রী নিচ্ছে। তাই ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন যাত্রীরা।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল চৌধুরী শনিবার মোবাইল ফোনে বলেন, ‘সড়কে যেমন মৃত্যুর মিছিল থামছে না তেমনি বাসের ভেতরে এখন প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। যাত্রীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য দেশের সব বাস, লঞ্চ ও রেলস্টেশনের প্রবেশপথে থার্মাল স্ক্যানার স্থাপন, গাড়ির ভেতরে যাত্রী দাঁড়ানো নিষিদ্ধকরণ ও নিয়মিত জীবাণুনাশক স্প্রে করার দাবি করেছি। কিন্তু তারা আমাদের দাবি এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করেনি।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, যদিও গণপরিবহনে যাত্রী সংখ্যা কমে গেছে, তারপরও একটি বাসে ৩০ থেকে ৫০ জন যাত্রী থাকে। তারা প্রতিনিয়ত বাসের হ্যান্ডেল ধরছে, সিট ধরছে, ময়লা সিটের কাভারে বসছে এতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে। তার মধ্যে অনেক যাত্রী হাঁচি-কাশি দিয়ে এই ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, যেহেতু বাস, উবার-পাঠাও, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ যেকোনো ধরনের গণপরিবহনে জীবাণুনাশক স্প্রের ব্যবস্থা নেই, তাই যাত্রীদের নিজ দায়িত্বেই নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে হবে।
পাটুরিয়া ঘাট থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত চলাচলকারী সেলফি পরিবহনের এক যাত্রী বলেন, সংক্রমণের ক্ষেত্র হিসেবে রাজধানীতে চলাচলকারী গণপরিবহন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। অধিকাংশ বাস গাদাগাদি করে যাত্রী ওঠানোর কারণে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন যাত্রীরা। একই শঙ্কার কথা জানান লাব্বাইক পরিবহনের আরেক যাত্রী। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের আতঙ্কে রাজধানীতে গণপরিহনের সংখ্যা ও যাত্রী কমে গেলেও বাসচালক ও হেলপারদের মধ্যে কোনো সচেতনতা তৈরি হয়নি। অতিরিক্ত অর্থের লোভে গাদাগাদি করে যাত্রী তুলছে। এখন রাজধানীর কোনো বাসই সিটিং সার্ভিস নেই। সব পরিবহনের হেলপাররা ইচ্ছেমতো বাস থামায়। গাদাগাদি করে যাত্রী তোলে। বসার জায়গা দিতে না পারলেও একজনের গায়ে ঘেঁষে আরেকজন দাঁড়িয়ে থাকেন। প্রায় সব বাসের সিটের কাভার ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত। ঠিকমতো পরিষ্কার না করেই রাস্তায় নামানো হয় এসব বাস। সিটের নিচে, ওপরে, বাসের জানালার পাশ দিয়ে দীর্ঘদিনের ময়লা (অধিকাংশ বমি) জমে থাকলেও তা কখনই পরিষ্কার করা হয় না।
সাভারের বাইপাইল থেকে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ডগামী চলাচলকারী লাব্বাইক পরিবহনের একাধিক যাত্রী জানান, বাইপাইল বা নবীনগর থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত যেতে লাব্বাইক পরিবহনের একটি বাস কমপক্ষে ১৩০ জায়গায় থামে। বেশিরভাগ পয়েন্ট থেকেই নতুন নতুন যাত্রী ওঠে। এদের মধ্যে কে কোন জীবাণু বহন করছে তা কেউই জানে না। এর মধ্যে একজন যাত্রী আরেকজনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকেন। অনেকেই হাঁচি-কাশি দিয়ে থাকেন। যাত্রীদের এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে লাব্বাইক পরিবহনের সহকারী আবদুস সালাম বলেন, এখন তো যাত্রী কম। তেল, জিপি ও টোল খরচই উঠছে না। স্প্রে করার টাকা পাব কই?
একাধিক যাত্রীর ভাষ্য, গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ না করলে করোনাভাইরাসের ভয়াবহভাবে বিস্তার ঘটতে পারে। তাই বিশেষ সতর্কতার নির্দেশনা প্রচারের পাশাপাশি গণপরিবহনকে জীবাণুমুক্ত রাখতে জরুরি ভিত্তিতে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। বাস টার্মিনাল ও বাস স্টপেজ, রেলস্টেশন, লঞ্চ-টার্মিনালে সব যাত্রীর স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ গতকাল বলেন, আগামী দুয়েক দিনের মধ্যে এমনিতেই বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। তাই আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। যদিও আমরা বেশ কয়েক দিন আগেই মিটিং করে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঝুঁকি কমানোর জন্য সব ধরনের যানবাহন নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার নির্দেশ দিয়েছি। স্প্রে করতে বলেছি। এসব নির্দেশনা অনেকে মেনে চললেও রাজধানীতে চলাচালকারী গণপরিবহন মানছে না। কারণ এখানে যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা করে। তাই এসব নির্দেশনা মানা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।