রোগ প্রতিরোধে মহানবী যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন

0

স্বাস্থ্যই সম্পদ। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁরই ইবাদতের জন্য। তাই যথাযথভাবে ইবাদত করার জন্য দরকার শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক সুস্থতা। একজন মুমিনের জন্য মহান রবের দেয়া এই সুস্বাস্থ্য অন্যতম একটি আমানত। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন- ‘দুটি নিয়ামতের বিষয়ে বেশির ভাগ মানুষ অসতর্ক ও প্রতারিত। সেগুলো হলো- সুস্থতা ও অবসর’ (সহিহ বোখারি)। কিয়ামতের দিন বান্দাদেরকে যেসব নিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে তন্মধ্যে সর্বপ্রথম প্রশ্ন করা হবে সুস্থতা প্রসঙ্গে। তাকে বলা হবে- ‘আমি তোমাদের শারীরিক সুস্থতা দেইনি?; (সুনানে তিরমিজি)।

ইসলামের দৃষ্টিতে ‘অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করার চেয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উত্তম।’ আধুনিক যুগে চিকিৎসাবিজ্ঞান ইসলামের সেই থিওরি স্বীকার করে ঘোষণা করে, Prevention is better than cure. অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ রোগ নিরাময়ের চেয়ে শ্রেয়। রোগাক্রান্ত হলে অবিলম্বে চিকিৎসা নেয়া ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে জরুরি। বিশ্বনবী সা: অসুস্থ হলে নিজে চিকিৎসা নিতেন এবং তাঁর অনুসারীদের চিকিৎসা নিতে উৎসাহিত করতেন।

সুস্থ থাকতে মানুষ চিকিৎসকের যেকোনো পরামর্শ বা চিকিৎসা গ্রহণ করতে প্রস্তুত। কিন্তু প্রায় দেড় হাজার বছর আগে মহানবী সা: মানবজাতিকে সুস্থ থাকতে যে সব নির্দেশনা দিয়েছেন তা পুরোপুরি মেনে চললে সুস্থতা অবধারিত। তাই যেসব নির্দেশনা মেনে চললে সুস্থ থাকা যায় তা নিচে উল্লেখ করা হলো-

১. মানুষ সাধারণত রোগাক্রান্ত হয় খাদ্য ও পানীয়ের দ্বারা। সে হিসেবে সব রোগের মূল কেন্দ্রস্থল মানুষের পেট। তাই খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে পরিমিত মাত্রায় খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। ইসলাম এ বিষয়ে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করতে নির্দেশ দিয়েছে এবং অতি ভোজন করতে নিরুৎসাহিত করেছে। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, রাসূলে আকরাম সা: ইরশাদ করেছেন, ‘পেটের এক-তৃতীয়াংশ খাদ্য দিয়ে, এক-তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খালি রাখবে’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)।

২. খাবার ও পানীয় ঢেকে রাখা। রাসূল সা: খাদ্য ও পানীয় সবসময় ঢেকে রাখার জোর তাকিদ দিয়েছেন। কেননা, তাতে অসুস্থতার পাশাপাশি মানুষের মৃত্যুরও ঝুঁকি রয়েছে। হাদিস শরিফে ইরশাদ হচ্ছে- রাসূলে আকরাম সা: বলেন, ‘তোমরা খাদ্য ও পানীয় ঢেকে রাখো, মশকের মুখ বন্ধ করে দাও, প্রদীপ নিভিয়ে দাও এবং ঘরের দরজা বন্ধ করে দাও। কারণ, শয়তান বন্ধ মশক খুলতে পারে না, বন্ধ দরজাও খুলতে পারে না এবং বন্ধ পাত্রও খুলতে পারে না। তোমাদের কোনো ব্যক্তি যদি পাত্র ঢাকার মতো কিছু না পায়, তবে সে যেন একটি কাঠ আড়াআড়িভাবে রেখে দেয় এবং আল্লাহর নাম স্মরণ করে’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)।

৩. খাদ্যে ফুঁ না দিয়ে খাবার শুরু করা। খাবার ও পানীয়ে ফুঁ দেয়ার কারণে অনেক ধরনের রোগ হতে পারে। ‘হজরত আবু সাইদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: পানীয়ে ফুঁ দিতে নিষেধ করেছেন। একজন আরজ করল, পাত্রে কখনো কখনো ময়লা দেখা গেলে কী করা? তিনি সা: বললেন, ‘তা ঢেলে ফেলে দেবে’ (তিরমিজি, রিয়াদুস সালেহিন)। আধুনিক বিজ্ঞান বিষয়টিকে জোর দিয়ে আমল করার পরামর্শ দিয়েছে। কারণ, পানীয়ে ফুঁ দিয়ে তা পান করলে তাতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড মিশে আমাদের শরীরে ক্ষতিকারক জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।

৪. হাত পরিষ্কার রাখার অভ্যাস সবারই থাকা দরকার। যার মাধ্যমে সহজেই অসুস্থতা থেকে বাঁচা যায়। হাত নানা ধরনের জীবাণু বহন করে বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁঁকি বাড়ায়। তাই রোগমুক্ত থাকতে নিয়মিত ভালোভাবে হাত ধুতে হবে। সঠিক নিয়মে হাত ধোয়ার অভ্যাস একটি ভালো ভ্যাকসিনের চেয়ে বেশি কাজ করে। তাই দেড় হাজার বছর আগে খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধৌত করার প্রতি ইসলামের নির্দেশ এসেছে। রাসূল সা: খাওয়ার আগে হাত ধোয়ার আদেশ দিয়েছেন। ‘আম্মাজান আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত। রাসূল সা: পানাহারের আগে উভয় হাত কব্জি পর্যন্ত ধুয়ে নিতেন’ (মুসনাদে আহমাদ)। আবার পায়খানা থেকে পানি খরচ করার পর বাইরে এসে মাটিতে হাত মলার অভ্যাস ছিল প্রিয় নবীজি সা:-এর। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘যখন নবীজি সা: পায়খানায় যেতেন আমি তাঁর জন্য পিতল বা চামড়ার পাত্রে পানি নিয়ে যেতাম। অতঃপর তিনি সা: ইস্তেঞ্জা করে মাটিতে হাত মলতেন’ (সুনানে আবু দাউদ)।

৫. দৈহিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতাও জরুরি। বরং মানসিক সুস্থতা দৈহিক সুস্থতার পূর্বশর্ত। কারণ মানসিক প্রশান্তি ও উৎফুল্লতা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। মানসিক উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতা দেহের রোগ প্রতিরোধ কমিয়ে ফেলে। তাই ইসলাম মনোদৈহিক স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ রেখে বৈবাহিক জীবন ব্যবস্থার প্রতি খুব গুরুত্ব দিয়েছে। তা ছাড়া ইসলামের ইবাদত ব্যবস্থা ও জিকির-আজকারের দ্বারাও মানসিক প্রশান্তি লাভ করা যায়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘জেনে রাখো! আল্লাহ তায়ালার জিকির দ্বারা অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়’ (সূরা রাদ-২৮)।

৬. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইসলামের মৌলিক নির্দেশনা ও ঈমানের অঙ্গ। পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার প্রতিও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কারণ, পরিবেশ দূষণের কারণে মানবসমাজে বিভিন্ন ধরনের রোগ ছড়ায়। হাদিসে এসেছে, রাসূলে কারিম সা: ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তোমাদের বাড়ির আঙ্গিনার সব দিকে পরিষ্কার রাখবে। ইহুদিদের অনুকরণ করো না। তারা বাড়িতে আবর্জনা জমা করে রাখে’ (সুনানে তিরমিজি)। তা ছাড়া কেউ যদি মিসওয়াক, অজু, গোসল, পোশাক-আশাক প্রভৃতির ক্ষেত্রে ইসলামী নির্দেশনা মেনে চলে, তাহলে সে অপরিচ্ছন্নতাজনিত রোগব্যাধি থেকে নিরাপদ থাকতে পারবে।

৭. যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করা নিষেধ করা হয়েছে। কারণ তাতে রোগব্যাধি ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলে কারিম সা: ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তিন অভিশপ্ত ব্যক্তি থেকে বেঁচে থাকো। তারা হলো- যে পানির ঘাটে, রাস্তার ওপর ও গাছের ছায়ায় মলমূত্র ত্যাগ করে’ (সুনানে আবু দাউদ)।

এক কথায়, আধুনিক বিজ্ঞান মানবদেহ রোগাক্রান্ত হওয়ার যেসব দিক নির্ণয় করেছে এবং এর প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছে, তা প্রায় দেড় হাজার বছর আগে মানবতার কল্যাণ ও মুক্তির কাণ্ডারি বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা: পুরোপুরিভাবে কুরআন ও হাদিসে বর্ণনা করে গেছেন। তাই বলা যায়, ইসলাম এমন একটি জীবন ব্যবস্থার নাম, যেখানে মানবতার কল্যাণ ও সফলতার জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার, সেখানে তাই করা হয়েছে।
লেখক : আলেম ও গবেষক

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com