মোদি ঠিকই সফরে যাবেন, তবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

0

শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে আগামী ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর বাংলাদেশে হতাশার সৃষ্টি করেছে।

এটা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ঠিক ‘সঙ্কট’ নয় কিন্তু এটা উভয় পক্ষের জন্য বিব্রতকর। মোদির ভারতের ব্যাপারে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে এখন তীব্র নেতিবাচক মনোভাব বিরাজ করায় এই আমন্ত্রণ সমস্যার মুখে পড়তে পারে বলে ভারত উদ্বিগ্ন। এই বিব্রতকর অবস্থার জন্য বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি)’র মতো তাৎক্ষণিক সমস্যাগুলো দায়ী।

হাসিনার জন্য এটা হলো মুজিব, মোদি নয়

নিজ দেশের উপর কঠোর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের। কূটনৈতিক বিবাদসহ পরিস্থিতি সামান্যতম কালিমালিপ্ত হোক সেটা তিনি মানবেন না। হাসিনার জন্য এটা কোন কূটনীতির বিষয় না হলেও তিনি কোনরকম টানাপোড়ন ছাড়াই আয়োজনটি উদযাপন করতে চান।

অনুষ্ঠানে ১৯৭১ সালের যুদ্ধবিজয়কেও স্মরণ করা হবে। তাই এতে ভারতের ভূমিকা আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়েছে। সিএএ-তে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। এতে নিশ্চিতভাবে শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তবে ভারতের ঘোষিত ‘সেরা বন্ধুটি’ খুব একটা ক্ষোভ দেখায়নি। এটা ভারতের আকার ও পরিস্থিতির কারণে। ভারত একটি বাস্তবতা এবং এক্ষেত্রে খুবই বড় ও উপকারি একজন। তার সঙ্গে কোনরকম কূটনৈতিক সংঘাত বাংলাদেশের জন্য সুখকর হবে না।

সফর কূটনীতি

মনে হচ্ছে এখনো বাংলাদেশের সামরিক-অর্থনৈতিক সামর্থ মাথায় রেখে ভারত তার বাংলাদেশ নীতি প্রণয়ন করে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীদের নিরাপদ আশ্রয়ের অবসান ঘটায় বাংলাদেশ। ফলে অনেকে ভেবেছিলেন ভারত এর প্রতিদান দেবে। তাই এখন প্রশ্ন উঠেছে: ভারত কি বাংলাদেশকে মর্যাদা দিয়েছে?

চীনের উত্থানে দৃশ্যপট বদলে গেছে। ভারত আর বাংলাদেশের শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদার নয়, স্থানটি চীনের দখলে। তবে ভারতের ভাবনা ঠিকই যে বাংলাদেশের চাল চালার ক্ষমতা সীমিত, কারণ দেশটি ইন্দো-চীন সম্পর্কের উপরও নির্ভরশীল। আগের চেয়ে পরিস্থিতি এখন অনেক বেশি জটিল।

সম্প্রতি বাংলাদেশের কয়েকজন নেতা ও কর্মকর্তার ভারত সফর বাতিল হয়েছে। সিএএ পাস ও এনআরসি শুরু হওয়ার পর থেকে এটা প্রায়ই দেখা যাচ্ছে। এই তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হলেন বাংলাদেশের পার্লামেন্টের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তার সফর অনেক আগে থেকে নির্ধারিত ছিলো। সাম্প্রতিক সময়ে মন্ত্রী পর্যায়ে সফরের মধ্যে ছিলেন শুধু তথ্যমন্ত্রী। কিন্তু তার সফর মিডিয়ায় তেমন কভারেজ পায়নি।

এগুলো হলো বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে চলার আলামত। একটি দুর্বল দেশ একটি সবল দেশকে সংকেত দিচ্ছে।

এরই প্রেক্ষাপটে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার ঢাকা সফর নিয়ে বাংলাদেশে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। বলা হয়, এটা ছিলো মোদির সফরের প্রস্তুতি পর্ব। কিন্তু তিনি এমন কিছু বলেননি যাতে বাংলাদেশ খুশি হতে পারে। তিনি আবারো বলেন যে সিএএ ও এনআরসি হলো ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং তা বাংলাদেশকে আঘাত করবে না।

বাংলাদেশীদের কাছে এই যুক্তির তেমন মূল্য নেই। ভারতে কেউ বাংলাদেশী হিসেবে হিসেবে চিহ্নিত হলেই ভারত তাকে শাস্তি দিচ্ছে। তাহলে বাংলাদেশ কেন এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হবে না?

মোদির সফর নিয়ে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক অবস্থান ঘোষণা করা হয়েছে। এটা হলো ১৯৭১ সালে ভারতের ভূমিকার জন্য ‘আতিথেয়তা’ ও ‘ধন্যবাদ’ জানানো। এই ক্রান্তিলগ্নে মোদি নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো ভারত।

চীন কি খানিকটা উদ্বিগ্ন?

মজার ব্যাপার হলো, যা ঘটছে তা নিয়ে কি বাংলাদেশের আরেক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার চীনকে মনে হচ্ছে কিছুটা বিচলিত। তারা জানে যে ভারতের চাপে ভারসাম্য আনার জন্য বাংলাদেশ চীনকে ব্যবহার করে। চীন বাংলাদেশে বড় আকারের বিনিয়োগ করছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি চীনের জন্য উদ্বেগ তৈরি করেছে, যা দেশটির আত্মবিশ্বাসকে কিছুটা নাড়িয়ে দিয়েছে। এর আগে তারা বাংলাদেশের মতো ছোট দেশগুলোর সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে অভেদ্য আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করতো। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ে দুর্ভাবনা এতটাই বড় যে চীন বাংলাদেশ সরকারের কাছে নিশ্চয়তা চেয়েছে যেন তার বিনিয়োগ ও প্রকল্পগুলো ব্যাহত না হয়।

বাংলাদেশ বলছে যে করোনাভাইরাসের কারণে বেশ কয়েকটি বড় অবকাঠামো প্রকল্প প্রভাবিত হতে পারে। তবে এগুলোর বাস্তবায়ন ধীর করে দেয়ার কোন পরিকল্পনা তাদের নেই। প্রকল্প ব্যয় ইতঃমধ্যে বহুগুণ বেড়ে গেছে। সবচেয়ে বড় প্রকল্প, পদ্মাসেতু প্রকল্পের কাজ চলবে। ভাইরাস সঙ্কট চলার মধ্যেও বেশ কয়েকটি নতুন প্রকল্পের কাগজপত্র বিনিময় হয়েছে।

বাংলাদেশের নিজস্ব অপদেবতা

নিজের অপদেবাতগুলোর বিরুদ্ধেই এখন লড়াই করছে বাংলাদেশ। এর একটি হলো আর্থিক খাতের আতঙ্কজন দশা, যা চুরি ও অবস্থাপনায় বিপর্যস্ত। দুটিই এত বড় মাপের যে, জাতীয় অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। অদক্ষতার জন্য খ্যাত নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে অসহায় মনে হচ্ছে। ফলে প্রত্যাশা মতোই যোগসাজসের-পুঁজিবাদের আধিপত্য সর্বত্র। এই ঝড় কখনো যদিও বা থামে, কিভাবে থামবে – সেটাই আরেক প্রশ্ন।

আর্থিক সঙ্কটের তুলনায় মোদির সফর খুবই ক্ষুদ্র একটি বিষয়। মোদিকে বিব্রত করার মতো কোন কিছু বলা বা করবে না বাংলাদেশ। জীবনে একবারই শতবর্ষ পালনের সুযোগ পাচ্ছেন শেখ হাসিনা এবং এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তিনি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে কোন বিতর্কিত কিছু ঘটতে দেবেন না। ভারতের ঘনিষ্ঠ বন্ধুটি আর ঘনিষ্ঠ থাকে কিনা সেটা অবশ্য দেখতে হবে।

কূটনীতি হলো পারস্পরিক সুবিধা বিনিময় হলেও দুনিয়া বড়ই অনিশ্চিত। এখনতো আরো বেশি। এসব বিষয় ভবিষ্যৎ সম্পর্ককে কীভাবে রূপ দেবে সে বিষয়ে ধারণা করা যায় মাত্র।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com