যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনকে জরুরি ভিত্তিতে দুটি চিঠি দেবে সরকার

0

বাংলাদেশি পণ্যের ওপর নতুন করে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আগামী তিন মাস কার্যকর না করে আগের শুল্কে পণ্য রপ্তানির সুযোগ চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনকে জরুরি ভিত্তিতে দুটি চিঠি দেবে সরকার। চিঠিতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানিতে শুল্ক কমানো এবং অশুল্ক বাধা দূর করার মাধ্যমে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেবে। প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে সে দেশের সঙ্গে আলোচনা করে বাড়তি শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহারের চেষ্টা করবে সরকার।

গতকাল রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক পর্যালোচনা বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে চার উপদেষ্টাসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ী নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানো এবং তাদের পণ্যে শুল্ক কমানোর প্রস্তাব নিয়ে অগ্রাধিকার নিয়ে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করেন সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা।

ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে কোনো দেশ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রদর্শনে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিলে বাড়তি শুল্ক কমানো বা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির কার্যালয় (ইউএসটিআর) সে দেশের অর্থ, স্বরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে পরামর্শ করে তাঁর কাছে এ ধরনের সুপারিশ করলে ট্রাম্প তা অনুমোদন করবেন।

গতকালের বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, গত ২ এপ্রিল শুল্ক আরোপের পর প্রতিনিয়ত যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। রোববারের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে দুটি চিঠি দেওয়া হবে। একটি চিঠি যাবে প্রধান উপদেষ্টার তরফ থেকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে। আরেকটি চিঠি যাবে বাণিজ্য উপদেষ্টার তরফ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) কার্যালয়ে।

চিঠির বিষয়বস্তু জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। পুরো কৌশল কেমন হবে এবং কোন কোন কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হবে, তা থাকবে। চিঠিতে যাই থাকুক, তাতে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের স্বার্থ দেখা হবে। বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে আরও বেশি ব্যবসাবান্ধব উদ্যোগ নেওয়া হবে, যাতে করে বর্তমান পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ উভয়ই লাভবান হয়।

বৈঠকে উপস্থিত ব্যবসায়ী প্রতিনিধি লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুরের কাছে জানতে চাইলে তিনি সমকালকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যে শুল্ক আরোপ করেছে, তা কার্যকর যেন তিন মাস পিছিয়ে দেওয়া হয়, সে বিষয়েই অনুরোধ করা হবে। একই সঙ্গে ৩৭ শতাংশ শুল্কের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ থাকবে।

বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে। আমদানি বাড়িয়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো হবে। পণ্যের পাশাপাশি সেবা আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অশুল্ক বাধা যেন আমেরিকান ব্যবসায়ীদের সমস্যায় না ফেলে, সে বিষয়ে শিগগির উদ্যোগ নেওয়া হবে। একই সঙ্গে দেশের তৈরি পোশাক খাতসহ অন্যান্য শিল্পকে আরও প্রতিযোগী সক্ষম করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ মনে করে বাংলাদেশি পণ্য অনেক ভালো। এ সুনাম ধরে রাখতে হবে।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে অন্যান্য বড় অর্থনীতির দেশ যেমন– চীন এবং ইউরোপ এর বিপক্ষে আরও কিছু পদক্ষেপ নেবে। পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, কেউ জানে না। তবে পুরো বিশ্বের অর্থনীতি বড় ধরনের নাড়াচড়া খাবে– এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক যেন রক্ষা পায়, সেই চেষ্টা করা হবে জানিয়ে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, এ খাতে শ্রমিকের মজুরি সর্বনিম্ন জায়গায় আছে। এর থেকে কমানো যাবে না। বরং উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হবে। একই সঙ্গে অশুল্ক বাধা দূর ও বাণিজ্য বাড়ানোর চেষ্টা করা হবে।

বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য সহায়ক নীতি গ্রহণ এবং সে দেশের কাছে কীভাবে উপস্থাপন করা হবে, তার কৌশল বোঝার জন্যই এ বৈঠক। শুল্ক ও অশুল্ক বাধা রহিত করার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সে অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে সঙ্গে সমঝোতা করা হবে।

প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান বলেন, দেশের স্বার্থ বজায় রেখেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানো সম্ভব। শনিবার যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। রাষ্ট্রদূত ইউএসটিআর অফিসে কথা বলেছেন। সেখান থেকে যে সংকেত পাওয়া গেছে, তাতে বাংলাদেশের চিন্তাধারার সঙ্গে মিল রয়েছে। আগামী এক-দুই দিনের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার করণীয় চূড়ান্ত করতে পারবে বলে আশা করছেন তিনি।

ব্রিফিংয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা চিন্তিত ছিলাম। আজকের আলোচনায় একটা পথনির্দেশনা পেয়েছি। যে কৌশল নেওয়া হয়েছে, তা ব্যবসায়ীদের জন্য সুখবর।’ ব্যবসায়ী সৈয়দ নাসিম মনজুর বলেন, ‘সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায় ব্যবসায়ীদের মাধ্যে কিছুটা স্বস্তি দেখা দিয়েছে। কারণ এ বিষয়ে নির্দিষ্ট সময়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে আমরা পিছিয়ে পড়ব। এ ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থ মাথায় রেখে সুযোগ খুঁজে বের করতে হবে। একটা জিনিস আমরা সবাই একমত যে, দেশের প্রতিযোগী সক্ষমতা যেন না হারায়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও কী কী জিনিস কিনতে পারি, সে বিষয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। আমাদের রপ্তানিও যেন স্বাভাবিক থাকে। এ ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের স্বার্থ বিবেচনায় নিতে হবে।’ বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, ‘চিঠি পেয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প টুইট করবেন, সেই প্রতীক্ষায় থাকলাম।’

বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী লুৎফে সিদ্দিকী, বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী, অর্থ সচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খান, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান, বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রমুখ।

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা শুল্ক নিয়ে আলোচনার জন্য গতকাল সকালে বাংলাদেশে ভারপ্রাপ্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের সঙ্গে বৈঠক করেন সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জসিম উদ্দিন, শিল্প উপদেষ্টা মো. আদিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী ও বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়িয়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা (পিপিআর) সংশোধন করে মার্কিন কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশের সরকারি প্রকল্পে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়া কিছু নির্দিষ্ট মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক কমানো, মেধাস্বত্ব আইন (আইপিআর) কার্যকর করা এবং দেশের সামগ্রিক ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
এ ছাড়া গতকাল বাণিজ্য সচিব মো. মাহবুবুর রহমানের সভাপতিত্বেও একটি ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ বৈঠকেও ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর পাশাপাশি বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তির (টিকফা) আওতায় আলোচনার মাধ্যমে বাড়তি শুল্কের বিষয়টি নিষ্পত্তির সুপারিশ এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের যেসব পণ্যে শুল্ক কমতে পারে

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হয় এমন ৩০ থেকে ৩৫টি পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক কমাতে পারে বাংলাদেশ। এ জন্য গত শনিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে আলাদা প্রস্তাব দিয়েছে এনবিআর ও বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। এর মধ্যে ১০ থেকে ১২টি পণ্যে শুল্ক কমানোর কথা বলেছে এনবিআর। বিডাও বেশ কয়েকটি পণ্যে শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করেছে। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে কৃষি পণ্য, জেনারেটর, গরুর মাংস, কিছু শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি এবং বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রিক্যাল পণ্য।

এনবিআরের হিসাব বলছে, প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যেসব পণ্য আমদানি হয়, তার গড় শুল্কহার ৬ শতাংশ। গাড়ি, অ্যালকোহলসহ কিছু বিলাসপণ্যে ২০০ থেকে সাড়ে ৬০০ শতাংশ শুল্ক রয়েছে, যার আমদানি খুবই কম। সরকার যেসব পণ্যে শুল্কহার বেশি, তা কমিয়ে আনার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া কোনো অশুল্ক বাধা থাকলে তা দূর করা হবে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.