তদন্তের সময় বাড়ে ফল আসে না

0

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিসহ চাঞ্চল্যকর অনেক হত্যার তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই। বিভিন্ন সময় ঘটে যাওয়া বেশকিছু হত্যার তদন্তের সময় বাড়ানো হয় কিন্তু আশাব্যঞ্জক কোনো ফল আসে না। ফলে, অপরাধীরা থেকে যাচ্ছে অধরা। পাশাপাশি এসব হত্যার রহস্য থেকে যাচ্ছে অজানা। তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা থাকায় ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যরা এখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। এসব মামলায় বছরের পর বছর ধরে  একের পর এক তদন্ত কর্মকর্তা বদলি হচ্ছেন। নতুন তদন্ত কর্মকর্তা এসে মামলা বুঝতেই সময় পার করে দিচ্ছেন। অনেক সময় তদন্ত কার্যক্রম শুরু করতে করতে তিনি আবার অন্যত্র বদলি হয়ে চলে যাচ্ছেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বরাবরের মতো একই বক্তব্য দিয়ে আসছেন। তদন্ত চলছে শিগগিরই প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। চাঞ্চল্যকর এসব হত্যাকান্ডে তদন্ত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অপরাধ বিশ্লেষক, ভুক্তভোগীর পরিবার, সহকর্মীরা। ওদিকে দীর্ঘসূত্রতার কারণে গ্রেপ্তার অনেক আসামি জামিনে বের হচ্ছে।

সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনী
হত্যাকান্ডের আট বছর পার হয়েছে গতকাল। এ দীর্ঘ সময়েও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। সোমবার এই মামলার প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য ছিল। তবে প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেননি তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার শফিকুল আলম। তাই ঢাকার মে?ট্রোপ?লিটন ম্যা?জি?স্ট্র্রেট দেবব্রত বিশ্বাস প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ফের ২৩শে মার্চ দিন ধার্য করেছেন। এ নি?য়ে প্রতিবেদন দা?খি?লের তা?রিখ ৭১ বার পেছালো। এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার শফিকুল আলম বলেছেন, গতকালও তিনি প্রতিবেদন দিতে পারেননি। প্রতিবেদন দিতে আরও সময় লাগবে। সেজন্য তিনি আদালতের কাছে সময় চেয়েছেন। প্রতিবেদন দাখিলে বিলম্বের কারণ নিয়ে তিনি বলেন, আসামিকে শনাক্ত করা যায়নি, তাই দেরি হচ্ছে। খন্দকার শফিকুল আলমের আগে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন, র‌্যাবের আরেকজন এএসপি মহিউদ্দিন আহমেদ।

তার আমলেও কোনো আগ্রগতি ছিল না। তিনিও প্রতিবেদন দাখিল করতে না পেরে বার বার সময় চেয়েছিলেন। ৭০ বার প্রতিবেদন দালিখের পরে গত ১১ ন?ভেম্বর এই মামলার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ ক?রেন হাইকোর্ট। মামলার আইও র‌্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার শফিকুল আলম সে?দিন উচ্চ আদালতকে জানান, তদন্তে কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি। চারটি ডিএনএ প্রতিবেদনের মধ্যে দু’টি মিলেছে। এ দু’টিতে আসামিদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি বলে সেগুলো ফের যুক্তরাষ্ট্রে এফবিআইর ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। ঢিলেতালে তদন্ত চলায় হতাশা প্রকাশ করেছেন নিহতদের পরিবার। মামলার বাদী ও রুনির ভাই নওশের আলম রোমান বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা তো আদালতকে একটা কিছু জানাবেন। কিন্তু কোনো ফলোআপই জানাচ্ছেন না, অগ্রগতিই নেই। বরং বার বার সময় নিচ্ছেন, সর্বশেষ সোমবারও সময় চেয়েছেন। আদালতও যেখানে বার বার সময় দিচ্ছেন, সেখানে আমাদের আর কি বলার আছে!

২০১২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি তাদের ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে খুন হন। পরের দিন রুনির ভাই নওশের আলী রোমান বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। প্রথমে মামলাটির তদন্ত করেন শেরেবাংলা নগর থানার একজন কর্মকর্তা। ১৬ই ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্ত ভার পড়ে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল আলমের ওপর। তবে এর দুই মাস পর হাইকোর্টের আদেশে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় র‌্যাবকে। সেই থেকে আট বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি সংস্থাটি। তবে এর আগে দাখিল করা প্রতিবেদনে ডিএনএ প্রতিবেদন পাওয়ার কথা বলা হলেও চুরি যাওয়া ল্যাপটপ উদ্ধার হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে জব্দ হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি, বঁটি, ছুরির বাঁট, সাগর-রুনির পরনের কাপড়, সাগরের হাত-পা যে কাপড় দিয়ে বাঁধা হয়েছিল সেই কাপড় ও রুনির পরনের টি-শার্ট পাঠানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবরেটরিতে।

এর আগে এক প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতকে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষাগার থেকে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষার রিপোর্টগুলো পাওয়া গেছে। সে রিপোর্ট ও অপরাধচিত্রের প্রতিবেদন (ক্রাইম সিন রিপোর্ট) পর্যালোচনায় দুজন পুরুষের ডিএনএর পূর্ণাঙ্গ প্রফাইল পাওয়া গেছে। গ্রেফতারকৃত আট আসামি, নিহত দুজন এবং স্বজন মিলে ২১ জনের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছিল। এসব পরীক্ষায় সন্দেহভাজন খুনি শনাক্ত হয়নি। এই মামলায় গ্রেফতারকৃত আটজনের মধ্যে পাঁচজন- রফিকুল, বকুল, সাইদ, মিন্টু ও কামরুল হাসান ওরফে অরুণ মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণচন্দ্র রায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। গ্রেফতার দেখানো হয় পারিবারিক বন্ধু তানভীর এবং বাসার নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পাল ও হুমায়ূন কবীরকে। এদের মধ্যে তানভীর, মিন্টু ও পলাশ হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছে।

২০১৩ সালের ২১শে ডিসেম্বর ঢাকার গোপীবাগের আরকে মিশন রোডের ৬৪/৬ নম্বর আয়না বাড়ির দোতলায় কথিত ইমাম মাহাদীর প্রধান সেনাপতি পরিচয় দানকারী লুৎফর রহমান ফারুক (৬০), তার ছেলে মনির হোসেন (৩০), মুরিদ সাইদুর রহমান (৩০), মজিবুর রহমান (৩২), রাসেল (৩০) ও বাসার তত্ত্বাবধায়ক মঞ্জুর আলমকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। সিক্স মার্ডারের এই ঘটনায় লুৎফর রহমান ফারুকের ছেলে আব্দুল্লাহ আল ফারুক বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে ওয়ারী থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটি থানা পুলিশ হয়ে, মহানগর গোয়েন্দা সংস্থা (ডিবি) এরপর কাউন্টার টেররিজম এন্ড ট্র্যান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) তদন্ত করছে। কিন্তু দীর্ঘ ৬ বছরেও এই মামলার কোনো তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারেনি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। আদৌ কবে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারবেন সে বিষয়ে সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারছেন না তারা। যদিও এ ঘটনায় পুলিশ দুজনকে আগেই গ্রেপ্তার করেছিলো। এদের মধ্যে জেএমবি সদস্য তরিকুল ইসলাম আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জেএমবির শীর্ষ নেতারাই এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। সিক্স মার্ডারের মিশনে অংশ নেয় আটজন।

এই আটজনের মধ্যে চার জনের নাম উল্লেখ করেছে তরিকুল। তারা হলো, মাহফুজ, রনি, জাহিদ ও আতিক। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৫ সালে বাড্ডায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ও কথিত পীর খিজির হায়াত খান হত্যার সঙ্গে জড়িত জেএমবির আট সদস্যর টিমের সঙ্গে এই সিক্স মার্ডারের সম্পৃক্ততা আছে। খিজির খান হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে সিক্স মার্ডারের রহস্যর জট খোলে। এছাড়া হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত হাদিসুর রহমান সাগর ও মামুনুর রশিদ রিপনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা মিলে। সাগর ও রিপনকে সিক্স মার্ডার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তথ্যমতে, হত্যার শিকার লুৎফর রহমান ফারুক নিজেকে ইমাম মাহদীর প্রধান সেনাপতি ও পীর দাবি করতেন। তিনি ও তার অনুসারীরা ধর্মের প্রচলিত রীতিনীতি ও অনুশাসনের বাইরে নিজস্ব ধর্মীয় মতবাদ প্রচারের চেষ্টা করতেন। এতে করে একটি বিশেষ মহলের ক্ষোভ বাড়তে থাকে তার ও তার অনুসারীদের ওপর।

২০১৪ সালের ২৭শে আগস্ট রাতে ঢাকার পূর্ব রাজাবাজারের ১৭৪ নম্বরের নিজ বাসায় চ্যানেল আইয়ের ইসলামিক অনুষ্ঠান ‘কাফেলা ও শান্তির পথ’ উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকিকে গলাকেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। বাসার দুতলায় ফারুকীর স্ত্রী ও স্বজনদের আটকে রেখে তাকে হত্যা করে পালিয়ে যায় খুনীরা। ঘটনার পরদিন ফারুকির ছোট ছেলে ফয়সাল ফারুকি বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে শেরে বাংলা নগর থানায় একটি মামলা করেন। থানা পুলিশ হয়ে পরে মামলাটির তদন্ত দেয়া হয় মহানগর গোয়েন্দা সংস্থাকে (ডিবি)। মামলাটি ডিবিতে আসার এক বছর পরে হস্তান্তর করা হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি)। সিআইডির পরিদর্শক আরশেদ আলী মণ্ডল মামলার তদন্ত শুরু করেন। তিনি বদলি হওয়ার পর সিআইডির অগ্রানাইজড ক্রাইম টিম মামলার তদন্ত শুরু করে। সাড়ে পাঁচ বছরে এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে পারেননি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মোস্তফা কামাল মানবজমিনকে বলেন, গতমাসে আমরা তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করেছি। এখন নতুন তদন্ত কর্মকর্তা কাজ করছেন। আশা করছি খুব শিগগির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারবো।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com