এক বছরে ধর্ষণের শিকার ৮১৮ শিশু, খুন ১৮৩
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ও শিশুদের জনসমাগমে অনুপস্থিতি সত্ত্বেও সারাদেশে বাল্যবিয়ে, শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। ফলে বাংলাদেশে শিশুদের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক বলে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) এক পর্যালোচনায় উঠে এসেছে।
মঙ্গলবার (২২ ফেব্রুয়ারি) এমজেএফের জ্যেষ্ঠ কো-অর্ডিনেটর (মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন) শাহানা হুদা রঞ্জনার সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
মঙ্গলবার সকালে এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে ‘বাংলাদেশ শিশু পরিস্থিতি ২০২১’ শিরোনামে শিশুবিষয়ক সংবাদের আধেয়-বিশ্লেষণ থেকে প্রাপ্ত তথ্য উপস্থাপন করেছে এমজেএফ।
এতে বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ও শিশুদের জনসমাগমে অনুপস্থিতি সত্ত্বেও ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ৮১৮ জন শিশু ধর্ষণের শিকার ও ৯৪ জন শিশুকে ধর্ষণ চেষ্টা করা হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়ে নিহত হয়েছে ১৪ জন মেয়ে শিশু। এছাড়া যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১১০টি শিশু। ২০২০ সালে শিশু ধর্ষণের এ সংখ্যা ছিল ৬২৬।
দেশের আটটি জাতীয় দৈনিক থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রকাশিত শিশু অধিকার বিষয়ক সংবাদ পর্যালোচনা করে এ তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছে।
সংবাদ পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিভিন্ন কারণে রিপোর্টকালীন আত্মহত্যা করেছে ৭৮টি শিশু। এরই মধ্যে ৫৭ ছেলে ও ২১ মেয়ে। ২০২০ সালে আত্মহত্যাকারী শিশুর সংখ্যা ছিল ৩৪ ও আত্মহত্যার চেষ্টা করতে গিয়ে আহত হয়েছে ২৩ জন। মূলত পরীক্ষায় ফল বিপর্যয়, পরিবারের ওপর রাগ, প্রেম, উত্ত্যক্ত হয়ে, ধর্ষণের শিকার বা ধর্ষণ চেষ্টা, ধর্ষণের বা শ্লীলতাহানির বিচার না পাওয়া ও সাইবার ক্রাইম বা ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে।
বিভিন্ন কারণে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ১৮৩ জন শিশু ও হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে ১৩৫টি শিশুকে। ২০২০ সালে হত্যার শিকার হয়েছিল ১৪৫ জন শিশু। ৬৯ জন শিশু সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৫৮ জন। ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ও অন্যান্য দুর্ঘটনায় নিহত এবং আহত হওয়ার সংখ্যা ২০২০ সালের তুলনায় কমেছে।
অবনতিশীল শিশু পরিস্থিতি থেকে এটি সুস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের শিশুরা তাদের ঘরেই নিরাপদ নয়। অধিকাংশ শিশু ধর্ষণ পারিবারিক পরিবেশে পরিচিতদের মাধ্যমেই সংঘটিত হয়েছে।
প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শিশুরা কাদের মাধ্যমে ও কীভাবে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে? পরিবারের পরিচিতদের মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার হওয়া ছাড়াও প্রতিবেশীদের হাতে শিশুদের একটি বড় অংশ ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশুর সর্বনিম্ন বয়স দুই বছর। বেশিরভাগ শিশু খেলতে গিয়ে লোভ দেখিয়ে পরিচিতদের মাধ্যমে ধর্ষণ করা হচ্ছে। মূলত কম বয়সী শিশুরাই ধর্ষণের শিকার বেশি হচ্ছে। কিশোরীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে প্রেম করতে গিয়ে। স্কুল ও মাদরাসাছাত্রীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে শিক্ষক ও মাদরাসা শিক্ষকদের হাতে।
এর বাইরে নানা ধরনের নির্যাতনে আহত হয়েছে ২৫৪ জন শিশু। হারিয়ে গেছে ৩৮টি শিশু। ৫৭০ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা গেছে। ২০২০ সালে পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৬৫। নিখোঁজ হয়েছে ৩৮ শিশু। ২০২০ সালে নিখোঁজ ও অপহরণের শিকার হয়েছে ২২ জন শিশু। অপহরণের কারণ হিসেবে টাকা, প্রেম, বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান, প্রতিশোধ গ্রহণ, পাচার ও মুক্তিপণ দাবি সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে।
শিশু নির্যাতনের ৫৬টি ঘটনার মাধ্যমে ২৫৪ জন শিশু নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। ২০২০ সালে শিশু নির্যাতনের ১৬টি ঘটনা ঘটেছে। নির্যাতনকারী হিসেবে গৃহকর্তা, বাবা-মা, শিক্ষক, উত্ত্যক্তকারী, স্থানীয় চেয়ারম্যান, চাকরিদাতা, প্রতিবেশী ও সৎমা। এমনকি ২০২১ সালে অপরাধে সংশ্লিষ্ট হওয়া শিশুর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১২০, যা ২০২০ সালে ছিল মাত্র দুজন।
শিশুকে নিয়ে ২৫টি বিষয়ের ওপর নেতিবাচক খবর ছাপা হয়েছে ১ হাজার ৯৩০টি আর ইতিবাচক সংবাদ ছাপা হয়েছে ১২টি বিষয়ের ওপর ১০৬টি।
এমজেএফের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনামের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অতিথি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (শিশু ও সমন্বয় উইং) মুহিবুজ্জামান ও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি মাহবুবা বিলকিস। এমজেএফের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের প্রতিনিধিরাও আলোচনায় অংশ নেন। সম্মেলনে ‘বাংলাদেশ শিশু পরিস্থিতি ২০২১’র সার্বিক চিত্র তুলে ধরেন এমজেএফের কো-অর্ডিনেটর রাফেজা শাহীন।
মুহিবুজ্জামান বলেন, পত্রিকা থেকে প্রাপ্ত তথ্য হচ্ছে অপরাধ প্রবণতার ধারণামাত্র। ১৫টি পত্রিকা থেকে মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয় তথ্য গ্রহণ করে। ১০৯ হটলাইন নম্বরে প্রতিদিন অসংখ্য ফোন আসে। সেখান থেকে আমরা অপরাধের একটা ডাটাবেজ তৈরি করি।
এমজেএফের নির্বাহী পরিচালক বলেন, এমজেএফের বিশ্লেষণ অনুযায়ী শিশুরা নিজের বাসায় নিরাপদ নয়। শিশু ধর্ষণ ও শিশুকে যৌন হয়রানি বন্ধের জন্য সবাইকে এখনই জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। নতুবা এর হার আরও বাড়তে থাকবে। শিশু সুরক্ষায় নিয়োজিত সরকারি প্রতিষ্ঠানের সবাইকে আরও বেশি সহৃদয়বান হওয়ার পাশাপাশি শিশু অধিকার রক্ষায় সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানান শাহীন আনাম।
এমজেএফের বার্ষিক ‘বাংলাদেশ শিশু পরিস্থিতি’ পর্যালোচনার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো শিশু সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নীতিনির্ধারণী সুপারিশ তুলে ধরা।
জাতিসংঘ শিশু অধিকার কমিটি ২০০৯ সালে প্রণীত তাদের ‘বাংলাদেশ বিষয়ক সমাপনী পর্যবেক্ষণ’ প্রতিবেদনে বাংলাদেশ শিশু পরিস্থিতি নিরূপণের জন্য নিয়মিত তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণের একটি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে এমজেএফ ২০১১ সাল থেকে সংবাদপত্রকে উৎস হিসেবে ধরে শিশু সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের সংবাদ নিয়মিত সংরক্ষণ করতে শুরু করে।
ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিয়ে আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২১ সালে মোট ১৮টি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মেয়ে শিশুর সংখ্যা ৩৮ জন ও সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ঢাকায়। ৩৮ জন গৃহকর্মী ধর্ষণসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১২ জন নিহত, ২৪ জন আহত ও দুজন আত্মহত্যা করেছে। নিহত গৃহকর্মীদের মধ্যে চারজন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। আটজনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে।