গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত কেবল তত্বাবধায়ক সরকারই করতে পারে

0

যে আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে নির্বাচিত সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, কারচুপিবিহীন ও প্রশ্নহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হয়েছিল, সে লক্ষ্য যে আজও পূরণ হয়নি, তা বিগত দশ বছরে সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় সব ধরনের নির্বাচনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ভোট কেন্দ্র দখল, কারচুপি, জালভোট এমনকি ভোটের আগের রাতে ভোট হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। দেশের যে কোনো নির্বাচন এলেই সাধারণ মানুষ ধরে নেয়, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত। ক্ষমতাসীন দলের নমিনেশন পাওয়া মানে সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে সিটি মেয়র, পৌর মেয়র, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার গ্যারান্টি। ফলে ক্ষমতাসীন দলের নমিনেশন পাওয়ার জন্য প্রার্থীদের যে ভিড় লক্ষ্য করা যায়, ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের তার ছিঁটেফোটাও দেখা যায় না।

বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ক্ষমতাসীন দলের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে বিগত দিনে ঘোষণা দিলেও, দেখা যায়, এ ঘোষণায় তারা অটল থাকতে পারেন না। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য নিয়ে আবারও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হচ্ছে, আমরা দেখাতে চাই ক্ষমতাসীন দলের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দের বক্তব্য, নির্বাচনকে বিতর্কিত করার জন্য বৃহত্তম বিরোধী দলটি অংশগ্রহণ করে মাঝপথে সরে যায়। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষমতাসীন দল ও বৃহত্তম বিরোধী দলটির মধ্যে একধরনের বাগযুদ্ধ চলছে। এই বাকবিতন্ডা হলেও তা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখছে না। ফলে সাধারণ মানুষ ও ভোটাররাও নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তারা ভোট দিতে যায় না। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সমর্থকরাও অনেক সময় ভোট দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। তারা বিলক্ষণ জানেন, আমাদের প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত এবং তা নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন রয়েছে। কাজেই কষ্ট করে ভোট দিতে যাওয়ার দরকার কি!


দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা যে ভেঙ্গে পড়েছে, তাতে একজন সাধারণ মানুষও বোঝে। যেভাবে নির্বাচন হয়, তাকে তারা মানতে না পারলেও তাদের কিছু করার নেই। কারণ, তাদের ভোট দেয়ার যেমন সুযোগ নেই, তেমনি সরকার ও নির্বাচন কমিশন সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি। ফলে সাধারণ মানুষ নির্বাচনবিমুখ এবং আগ্রহহীন হয়ে পড়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশে গণতন্ত্র ও রাজনীতি বলে কিছু থাকবে না। তারা তাকিদ বোধ করছেন, ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি এবং গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য তারা পুরনো ফর্মূলা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’কেই উপযুক্ত মনে করছেন। এ পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার পরামর্শও দিচ্ছেন।

সুসাশনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত এক ভার্চুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, মানুষ ভোটকেন্দ্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় দেশের গণতন্ত্র ক্ষতি হচ্ছে। গণতন্ত্র ‘কাল্পনিক’ রূপ লাভ করায় উগ্রবাদীদের উত্থান ঘটতে পারে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনে নাগরিকদের ভোটকেন্দ্রমুখী করতে হবে। একইসঙ্গে তারা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে ‘বিরাজনীতিকরণ কমিশন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তারা বলেছেন, আগে দেখতাম সামরিক শাসকরা ক্ষমতা দখল করে বিরাজনীতিকরণ করেন, এখন বেসামরিক সরকারও ইসির সহায়তায় রাষ্ট্রকে বিরাজনীতিকরণ করেছে। অন্যদিকে বাম গণতান্ত্রিক জোটও নতুন করে নির্দলীয় তাদারকি তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলেছে। তাদের এসব বক্তব্য থেকে এটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, দেশের সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোট অনুষ্ঠানের জন্য দলীয় সরকার উপযুক্ত নয়। এর জন্য প্রয়োজন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ ধরনের সরকারের মাধ্যমে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব এবং মানুষ উৎসবমুখর হয়ে ভোট দিতে যায়, তা একাধিকবার প্রমানিত হয়েছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে যে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয় না, তাও প্রমানিত। এতে যেমন ভোটাররা ভোটাধিকার হারিয়েছে, তেমনি গণতন্ত্রও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। এই পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা যায়, অন্তত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং উৎসবমুখর পরিবেশে মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অনির্বাচিত হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারই সবচেয়ে বেশি কার্যকর।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com