অটো পাসের সংস্কৃতি

0

উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অটো পাস দেয়া হয়েছে। সর্বোচ্চ ফল জিপিএ ৫ পেতে কোনো কষ্ট করতে হয়নি। অন্য ফলের জন্যও ন্যূনতম প্রচেষ্টার দরকার পড়েনি। প্রতি বছর যে কয়েক লাখ ছাত্র ফেল করত এবার তেমন কেউ নেই। সবাই পাস। চমৎকার একটা সুযোগ! মানুষের সামাজিক অর্থনৈতিক জীবনে করোনা মহামারী ভয়াবহ পরিণাম বয়ে আনলেও ২০২০ সালের উচ্চ মাধ্যমিক ছাত্রদের জন্য হয়েছে পোয়াবারো।

অনেকে এমন আশঙ্কা করছেন, ২০২০ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পাস ছাত্ররা বিশেষভাবে চিহ্নিত হবে। অনেকে বলছেন, এটা একটা কালো দাগ শুধু ২০২০ শিক্ষাবর্ষের উচ্চ মাধ্যমিক ছাত্রদের গায়ে লেগে গেল। তারা শেষ পর্যন্ত নিজেদের পরিচয় দিতে হীনম্মন্যতায় ভুগবে। জাতির ইতিহাসে একটি দেউলিয়া ব্যাচ হিসেবে অনেকে নিজেদের পরিচয় গোপন করবেন। সরকার কেন এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করল তা নিয়েও বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। কারণ, করোনা উপলক্ষে এখন দেশের কোনো কাজই থেমে নেই। সেখানে কেন অটো পাস দেয়া হলো?

দেশের সব হাটবাজার উন্মুক্ত। জনসমাবেশ চলছে, বড় বড় জানাজায় বিপুল মানুষ জমায়েত হচ্ছেন। জেলা ও বিভাগীয় শহরে জনসমাগম হচ্ছে। মিল-কারখানা সাধারণ নিয়মে চলছে। পোশাক কারখানাগুলো চালু আছে। শপিংমল খোলা। করোনা ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ার জন্য অনুকূল পরিবেশ দরকার। সে পরিবেশ সম্পূর্ণ আমরা পরিচর্র্যা করছি। আমরা বুঝতে পারছি করোনা নিয়ে যে ভয়াবহ আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে; তা বাংলাদেশে কার্যত ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তার পরও শুধু ঠেকে গেল উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। করোনা যেন শুধু ছাত্রদের একসাথে হলে ভয়ানক আঘাত হানবে। দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টানা বন্ধ হয়ে আছে। সরকার পোশাক কারখানাগুলো তড়িঘড়ি করে খুলে দিয়েছিল। এ জন্য খুব ভাবনা-চিন্তাও করেনি।

সরকার মনে করেছে, অর্থ উপার্জনের রাস্তাটি যেকোনো মূল্যে খোলা রাখতে হবে। সব কিছুর মূলে অর্থ। পড়াশোনা বন্ধ রাখলে নগদ কোনো ক্ষতি নেই। তাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাইমারি স্কুল সব অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে। করোনাকালে অনেক কিছুই বিশেষ ব্যবস্থায় চালু করা হয়েছে। অনেক কিছু নিয়েই সরকার পেরেশান। শুধু শিক্ষা নিয়ে নেই কোনো চিন্তা। এটাকে মনে করা হচ্ছে অপশনাল। এতে করে শিক্ষার প্রতি আমাদের জাতীয় মূল্যবোধ প্রকাশিত হয়। আমরা আসলে শিক্ষার কোনো মূল্য দিতে পারিনি; যে কারণে আমাদের শিক্ষাও দিনে দিনে অধঃপাতে যাচ্ছে। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় আমাদের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও আলোচনায় নেই।

অটো পাস একটি সংস্কৃতি। ভবিষ্যতে যোগ্যতা পরিমাপের অন্যান্য পরীক্ষাও বাতিল হয়ে যেতে পারে এই রেফারেন্সে। আইনজীবী সনদ অর্জন পরীক্ষা নিয়ে ছাত্ররা এর মধ্যে অটো পাসের দাবি করেছেন। গত শনিবার অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় ছাত্রদের একটা অংশ পরীক্ষার হল ছেড়ে বেরিয়ে আসে। তারা বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্রে ভাঙচুর চালান। পরীক্ষা চালাতে বাধা দেয়। তারা দাবি করছেন- পরীক্ষার প্রশ্ন অত্যন্ত কঠিন হয়েছে। তাই তাদের একটি অংশ আইন পেশার সনদ পেতে অটো পাসের দাবি করেছেন। আইনজীবী সনদ পরীক্ষা দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ করে রাখা হয়েছে এমন অভিযোগ অনেকের। তাদের মতে, বর্তমান আইন পেশায় যারা বেশি বেশি অর্থ কামাই করছেন তারাই এ পরীক্ষাকে ঠেকিয়ে রেখেছেন। নতুন সদস্য বাড়িয়ে তাদের নিজেদের রমরমা ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে তারা চান না। তাই দীর্ঘ দিন চলে গেলেও সনদ প্রত্যাশীদের তারা পরীক্ষা নিতে চান না। পুরো প্রক্রিয়াটিকে তারা দীর্ঘসূত্রতার আবর্তে ফেলতে চান। যদিও আগে যারা সনদ পেয়েছেন; তারা শুধু একটি ভাইবা দিয়েই তা অর্জন করেছেন।

দেশে বিভিন্ন পেশার লোকদের মাঝে যোগ্যতা-দক্ষতার অভাব একটি আলোচনার বিষয়। সবাই একটা পেশা পেয়ে যেতে চান উপযুক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা ও দক্ষতা ছাড়াই। অন্য দিকে সরকার বরাবরের মতো কঠোর নিয়ম কানুন পালন করতে পারে না। আইনজীবী সনদ প্রত্যাশীদের সরকার শেষ পর্যন্ত অটো পাসের সুযোগ দেবে কি না আমরা জানি না। তবে এ দাবি আরো অনেকে ওঠাতে পারেন।

উচ্চ মাধ্যমিকে সরকার একটি ফর্মুলার মাধ্যমে গ্রেড নির্ধারণ করে দেবে। এই গ্রেড অনুযায়ী উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবে শিক্ষার্থীরা। এ ধরনের আরোপিত ফলাফল অনেক মেধাবী ছাত্রকে বঞ্চিত করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিগত কয়েক বছরে দেখা গিয়েছিল- একটি অসাধু চক্র বাংলাদেশের মেডিক্যাল ভর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে। দুর্নীতির মাধ্যমে অসাধু পন্থায় অনেকে মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ নিয়েছে। এমন তথ্যপ্রমাণ প্রকাশিত হয়েছে। এমন অবৈধ চক্রকে র‌্যাব আটকও করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়ও প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। পাবলিক পরীক্ষায় নকল অবৈধ আরো হাজারো রকমের কর্মকাণ্ড এদেশে এখন প্রকাশ্যে চলছে। এবার অটো পাস ভালো ছাত্রদের বঞ্চিত হওয়ার পথ তৈরি করবে।

অনেক অযোগ্য ছাত্র ভালো জায়গায় সুযোগ পেয়ে যেতে পারেন। আবার অনেক যোগ্য ছাত্র ভালো জায়গায় পড়ার সুযোগ না পেয়ে বঞ্চিত হতে পারেন। এতে তাদের জীবনে নেমে আসতে পারে হতাশা। বিশেষ করে মেডিক্যাল, বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপক হারে অমেধাবী ছাত্ররা সুযোগ পেয়ে যেতে পারে। উচ্চ মাধ্যমিকে অটো পাসের মাধ্যমে এবার জিপিএ ৫ দেয়া হচ্ছে এক লাখ ১০ হাজারের বেশি ছাত্রকে। এর আগের বছরগুলোতে দেখা গেছে, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৭০ হাজারের মতো ছাত্র জিপিএ ৫ পেয়েছে। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আসন রয়েছে প্রায় সমপরিমাণ। এবার ফর্মুলার মাধ্যমে অনেক বেশি ছাত্রকে সর্বোচ্চ ভালো ফল দেয়া হচ্ছে। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে ব্যর্থ হয়ে ভালো ছাত্ররা যে এবার বেশি বঞ্চিত হবে এটা নিশ্চিত। অর্থাৎ মেধাবীরা শেষ পর্যন্ত দেশের সেবায় কাজে আসবে না।

অটো পাস এখন ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের প্রতিটি সেক্টরে এখন চলছে অটো পাসের খেলা। শিল্প-সাহিত্য, গবেষণা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, জাতীয় সংসদ, স্থানীয় সরকার, রাজনীতি, ব্যবসায় ও বাণিজ্য- সব ক্ষেত্রে এখন আত্মঘাতী অটো পাসের সিস্টেম। আমাদের শ্রমিক নেতাদের সম্পর্ক নেই শ্রমিকদের সাথে। কৃষক নেতাদের সাথে সম্পর্ক নেই কৃষকদের। ছাত্রনেতারা অনেক আগে তাদের ছাত্রত্ব শেষ করেছেন কিংবা তারা ক্যাম্পাসে ‘আদুভাই’। এ জন্য আমাদের দুষ্টু রাজনৈতিক ব্যবস্থাই দায়ী। অনেকের পর্যবেক্ষণ- বাংলাদেশের রাজনীতি এখন অটো পাস ব্যবস্থায় চলছে। অনেকে হয়ে গেছেন এক রাতেই নেতা। এ জন্য তাদের কোনো অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়নি। কোনো দিন চর্চা করতে হয়নি রাজনীতি।

বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন সরকারকে অটো পাস দিয়ে এবারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই আলোচনায় এসেছে। তারা রাজনীতিকদের সরকার পরিচালনায় যোগ্য কি না সেই পরীক্ষার কাজটি সংবিধানে দেয়া অধিকার বলে যথাযথভাবে করার কথা। দেখা যাচ্ছে, তারা পরীক্ষা না নিয়ে চলমান সরকারের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে অনেকটাই অটো পাস দিয়ে দিলেন। ২০১৪ সালে আগেই একবার একই কাজ করেছিল নির্বাচন কমিশন। ২০১৮ সালে এসে সেটাকেই আরো নির্লজ্জভাবে করেছে। ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক বর্তমান নির্বাচন কমিশনারদের বিরুদ্ধে সরকারকে অটো পাস দেয়া ছাড়াও গুরুতর অসদাচরণ, আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ এনেছেন। শনিবার একটি সংবাদ সম্মেলন করে বিশিষ্ট নাগরিকদের পক্ষ থেকে বিষয়টি বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। তার আগেই তাদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির কাছে একটি চিঠি দেয়া হয়। ওই চিঠিতে কমিশনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে তদন্ত করার আহ্বান জানানো হয় রাষ্ট্র্রপতির কাছে।

তাদের বিরুদ্ধে এসব গুরুতর অভিযোগের ব্যাপারে কমিশনাররা আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি। তবে নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বিশিষ্ট নাগরিকদের এ অভিযোগের ভিত্তি আছে বলে তিনি মনে করেন না। তার মতে, এসব অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে থাকতে পারে। আর্থিক অনিয়মের যেসব অভিযোগ নাগরিকরা এনেছেন, সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নেই। তবে রাষ্ট্রপতি চাইলে দেশের স্বার্থে এগুলো তদন্ত করে দেখতে পারেন। তবে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে পরিচালিত নির্বাচনগুলোর প্রত্যক্ষ সাক্ষী সাধারণ মানুষ। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচন পরিচিতি পেয়েছে নিশি নির্বাচন হিসেবে। ওই নির্বাচনে আগের রাতেই ভোট অনেকটা সম্পন্ন হয়ে যায়। এর আগে থেকে ভোটারদের বাধা দান, বিরোধীদের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, বিরোধী প্রার্থীদের সন্ত্রাসী কায়দায় এলাকা ছাড়াকরণ একটি সাধারণ ঘটনা হলেও নির্বাচন কমিশনের এজেন্টরা এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। এগুলোর প্রত্যক্ষদর্শী দেশের সাধারণ মানুষ। জনসাধারণের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন এ অপরাধ সংঘটিত করেছে।

নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান, অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলী খান, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম ও অধ্যাপক আসিফ নজরুল। ৪২ জন নাগরিকের বাকিরাও এদেশে সজ্জন হিসেবে পরিচিত। তারা বিভিন্ন সময়ে জাতির কল্যাণে ভূমিকা রেখেছেন, এখনো রাখছেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার সময় তাদের বিরুদ্ধে কেউ গুরুতর অসৎকর্ম দূরে থাক, ছোটখাটো অপরাধের অভিযোগও উত্থাপন করেনি। তারা জাতির বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কোনো কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত হবেন এমনটা সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করেন না। অন্য দিকে বর্তমান নির্বাচন কমিশন নির্লজ্জভাবে এ দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা যে ধ্বংস করে দিয়েছে, তা সবারই জানা।

রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা যে অটো পাসের সংস্কৃতি চালু করেছি সেটা আত্মবিনাশী। রাজনীতিকে একটি দেশের চালিকাশক্তি বলা হয়। এটি যদি ভুল নির্দেশনায় চলতে থাকে সে জাতির সর্বনাশ আসন্ন। এ থেকে বের হওয়ার জন্য বিশিষ্ট নাগরিকরা যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু এ উদ্যোগ ততদিন আলোর মুখ দেখবে না যত দিন রাজনীতিকরা নিজেদের ভুল শুধরে নিতে প্রস্তুত না হন। প্রথমে ভুলের উপলব্ধি দরকার। এরপর উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে। নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে যদি রাষ্ট্র হিসেবে আমরা সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি নিতে পারি তাহলে শিগগিরই আমরা অটো পাস সংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার পথ তৈরি করতে পারব।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com